[চোখের বালি (A Passion Play)/চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : ঋতুপর্ণ ঘোষ/কাহিনি-উৎস : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘চোখের বালি’/প্রযোজনা : শ্রীকান্ত মেহতা ও মহেন্দ্র সনি/চিত্রগ্রহণ : অভীক মুখোপাধ্যায়/সংগীত : দেবজ্যোতি মিশ্র/সম্পাদনা : অর্ঘ্যকমল মিত্র/অভিনয়ে : প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (মহেন্দ্র), ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন (বিনোদিনী), রাইমা সেন (আশালতা), লিলি চক্রবর্তী (রাজলক্ষ্মী), টোটা রায়চৌধুরী (বিহারী)/দৈর্ঘ্য : ২ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট/ভাষা : বাংলা/মুক্তি : ২০০৩]
১৯০১-১৯০২ সালে ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় যখন ‘চোখের বালি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কাহিনির জন্য শুরু থেকেই কট্টরপন্থী হিন্দু সমাজের সমালোচনার মুখে পড়েন। সমাজের অনেক কুসংস্কার এবং নিকৃষ্ট প্রথার বিরুদ্ধে ততোদিনে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা শুরু হয়েছে। সতীদাহ প্রথা এবং বহুবিবাহ প্রথা রোধ হওয়ার পাশাপাশি ‘বিধবা বিবাহে’র প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে রক্ষণশীল সমাজ তা সহজে গ্রহণ করেনি। একজন অল্প বয়সী বিধবা নারী সারাটা জীবন ধরে যে ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা এবং বেদনার দুঃসহ ভার বয়ে বেড়ান, তা বোঝার মতো সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যা সে সময়ে খুব বেশি ছিলো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানাবিধ ব্রত-আচার, নিরামিষ খাবার আর সাদা থানের জালে আটকে ফেলে তাদের গোটা জীবনটাকে ধ্বংস করাই যেন ছিলো নিয়তি। অতঃপর রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবদের একান্ত প্রচেষ্টায় উজ্জ্বল আলোকরেখার মতো পরিবর্তন আসতে শুরু করলো।
যে মেয়েটি জীবনের সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিধবা হয়েছে, তার জীবনেও যে প্রেম আসতে পারে, একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন থাকতে পারে, অথবা অতীতের সব দুঃস্বপ্নকে মুছে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে–তা মেনে নেয়ার মতো শক্তি সাধারণ মানুষের তো ছিলোই না, এমনকি সাহিত্যিকরা যারা স্বপ্নডানায় ভর করে অবিরাম ভ্রমণ করতে সক্ষম, তারাও এই দুঃসাহস দেখাতে পারেননি। বিধবা নারীর জীবনে প্রেম আসার সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথই যে প্রথম ‘চোখের বালি’তে দেখিয়েছেন এমন নয়, তারও আগে দেখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) উপন্যাস দুটিতে কুন্দনন্দিনী এবং রোহিণী নামের দুই বিধবার রূপে উপন্যাসের নায়করা আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু উপন্যাসের শেষে তাদের দুজনেরই মৃত্যু ঘটিয়ে বিধবার জীবনে পুনরায় সংসার যাপনের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পর ‘বিষবৃক্ষে’র শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।’ অর্থাৎ বিধবার প্রতি আকৃষ্ট হয়ার ফল যে ভয়াবহ হবে, তা নিয়ে পুরুষ সমাজকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন তিনি। আবার ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসেও বিধবা রোহিণীকে তাঁর প্রেমিক স্বয়ং গোবিন্দলাল পিস্তলের গুলিতে হত্যা করেছিল। অর্থাৎ বিধবার জীবনে সুখ সমাপ্তি ঘটানোর মতো সাহস বা মানসিকতা কোনোটিই বঙ্কিমচন্দ্র দেখাতে পারেননি।
বঙ্কিমচন্দ্রের আরও প্রায় বাইশ বছর পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর উপন্যাসে বিধবার প্রসঙ্গ আনলেন সেখানে আরেকটু সাহসের পরিচয় পাওয়া গেলো বটে। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘চোখের বালি’র একটি সংস্করণের ভূমিকায় তিনি নিজেও লিখেছিলেন :
‘আমার সাহিত্যের পথযাত্রা পূর্বাপর অনুসরণ করে দেখলে ধরা পড়বে যে ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটা আকস্মিক, কেবল আমার মধ্যে নয়, সেদিনকার বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে।’
বর্ণনের সাহসিকতা বা কল্পনার বিস্তারে রবীন্দ্রনাথ হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, কিন্তু বিধবার অন্তিম পরিণতির যে চিরাচরিত গঠন তা কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ভাঙতে পেরেছিলেন? সে প্রসঙ্গে পরে কথা হবে। আমরা বরং ফেরত আসি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’তে। বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে অবিচ্ছেদ্য এবং বিস্তারী প্রভাব তা থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষও মুক্ত ছিলেন না, বরং রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি গাঢ় অনুরাগ ছিলো তাঁর। এজন্য তাঁর চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথ। ‘চোখের বালি’ এবং ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস অবলম্বনে দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘জীবনস্মৃতি’ নামে একটি অন্য ধারার প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এর বাইরে তাঁর ‘অসুখ’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের একটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, এমনকি ‘বাড়িওয়ালি’ (২০০০) চলচ্চিত্রে বনলতার বাড়িটি যে সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছিল তা হলো রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘চোখের বালি’র চলচ্চিত্ররূপ দেয়ার আকাঙ্ক্ষা ঋতুপর্ণ ঘোষের মাঝে একটা দীর্ঘ সময় ধরে সুপ্ত ছিলো।
রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে। এর ঠিক ১০০ বছর পরে ২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’। মাঝে এক শতাব্দী ধরে পৃথিবীজুড়ে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন, বদলে গেছেন অনেক কিছুই। স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ লিখতে যতোটুকু স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এর চিত্ররূপ দিতে গিয়ে তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষই যে ‘চোখের বালি’র প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন এমন নয়। এর আগেও কয়েকবার এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ এবং নাট্যরূপ প্রদান করা হয়েছে। তবে বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রগতিশীল ধারায় গত শতাব্দীতে যে সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই আশানুরূপ সাফল্য বা দর্শক আনুকূল্য লাভ করেনি। এদের তুলনায় এই শতাব্দীতে এসে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’ দর্শকদের মাঝে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে। আলাদা করে কি আছে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’তে? এখন আমরা এদিকটাতেই আলোকপাতের চেষ্টা করবো।
২.
শুরুতেই ‘চোখের বালি’র কাহিতে আসা যাক। উল্লেখ করা ভালো হবে, এই কাহিনি রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র। মহেন্দ্রের মা রাজলক্ষ্মী তার ছোটোবেলার বান্ধবীর মেয়ে বিনোদিনীকে পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাতৃস্নেহ হারানোর দোহাই দিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিল পুত্র মহেন্দ্র। ফলে অন্যত্র বিয়ে হয় বিনোদিনীর এবং কিছুদিন পরেই স্বামীর মৃত্যু ঘটলে অকালে বিধবা হয় সে।
তিন বছর পরে মা আবার তার ছেলের বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। এবারও মহেন্দ্র পুরনো অজুহাত দেখায়। মহেন্দ্রের কাকি অন্নপূর্ণা তাদের সাথে একই বাড়িতে বাস করতেন। স্বামী-সন্তানহীনা এ মহিলাটি মহেন্দ্রকে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। অন্নপূর্ণার পিতৃমাতৃহীনা এক বোনঝি আশালতার সাথে মহেন্দ্রের বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করলেও প্রত্যাখাত হয়ার আশংকায় তা তিনি কখনও প্রকাশ করতেন না। তবে মহেন্দ্র এ ব্যাপারটি ঠিকই অনুধাবন করতো। অবশেষে মহেন্দ্র তার বন্ধু বিহারীর সাথে বিয়ে ঠিক করে সেই মেয়েটিকে দেখার জন্য কাকিকে প্রস্তাব করে। বিহারী মহেন্দ্রের বন্ধু হলেও তার মা রাজলক্ষ্মী এবং কাকি অন্নপূর্ণার স্নেহের পাত্র ছিলো সবসময়। আশালতাকে দেখতে গিয়ে মহেন্দ্র নিজেই বিয়ের জন্য মনস্থির করে এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজেই আশালতাকে বিয়ে করে। বিহারীও নিজের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে আশালতাকে পছন্দ করেছিল, কাজেই আশালতার প্রতি তার একটা দুর্বলতা থেকে যায়।
শুরু হয় মহেন্দ্র-আশালতার নতুন জীবন। স্ত্রী আশালতার প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে দিন দিন ছেলের ওপর কর্তৃত্ব হারাতে থাকে মা। আশালতা যেহেতু অন্নপূর্ণার বোনঝি–এ নিয়ে অন্নপূর্ণা ও রাজলক্ষ্মীর মনোমালিন্য শুরু হয়। অন্নপূর্ণা ধর্ম পালনের দোহাই দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কাশীতে, ছেলের ওপর রাগ করে রাজলক্ষ্মী চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। ফিরে আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসে বিধবা বিনোদিনীকে। অল্পদিনের মধ্যেই বিনোদিনী সংসারের সকলকে আপন করে নেয়। আশালতার সাথেও সই পাতায় সে। তাদের সেই সম্পর্কটির নাম দিয়েছিল ‘চোখের বালি’। মহেন্দ্রের সাথে পরিচয় হয়ার পর মহেন্দ্রও তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করা শুরু করে। এরপরই উপন্যাসের মূল সংকট উপস্থাপিত হয়। একদিকে বিনোদিনীর প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে মহেন্দ্র, আবার বিনোদিনীর দুর্বলতা সৃষ্টি হয় মহেন্দ্রের বন্ধু বিহারীর প্রতি। কিন্তু বিহারী আবার আশালতার প্রতি অনুরক্তভাব তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মহেন্দ্র-বিনোদিনী- আশালতা-বিহারী : চার নরনারীর সম্পর্কের জটিলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক টানা পোড়েনকে ঘিরেই এ উপন্যাসের সিংহভাগ আবর্তিত হয়েছে। বিহারীর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করে বিনোদিনী যখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তখন প্রতিহিংসার আগুনে সে আশালতার সংসার জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছে। মহেন্দ্রের সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় তীব্রতর করে তুলেছে সে। তারপর উপন্যাসের সমাপ্তিতে এসে সব জটিলতার সমাপ্তি ঘটে। মহেন্দ্র ফিরে যায় আশালতার কাছে। বিহারী নিজেকে নিয়োজিত করে দেশসেবায় এবং বিনোদনীকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও বিনোদিনী তার বৈধব্যের কালিকে বরণ করে নিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বিনোদিনীকে কাশীতে পাঠিয়ে সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার নীতিতে রবীন্দ্রনাথ একটি সন্তোষজনক সমাপ্তি টানেন।
৩.
সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় কাহিনিকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণের কোনো নিয়মতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা থাকে না পরিচালকের। ‘চোখের বালি’ নির্মাণের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতাকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাই রবীন্দ্রনাথের আখ্যানকে ব্যবহার করে তাঁর ‘চোখের বালি’র এই নির্মাণ একেবারেই স্বতন্ত্র।
চলচ্চিত্রজুড়ে একটা হারানো সময় বা ফেলে আসা সময়ের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাই স্বদেশি আন্দোলনের মিছিলের শব্দ ‘বন্দে মাতরম’ থেকে শুরু করে জগদীশচন্দ্র বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কার করা, নারী শিক্ষার প্রচলন, কিংবা সন্ন্যাসী নরেন অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কথা উপন্যাসের বাইরে থেকে তিনি আলাদাভাবে চলচ্চিত্রে এনেছেন।
বিনোদিনী চরিত্রটির আগমনী প্রস্তুতির জন্য ঋতুপর্ণ আমাদেরকে নিয়ে গেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে। সূচনাপর্বের সেই দৃশ্যে বিহারীর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে রোহিণীর পরিচিতি পাঠ করার অংশটি যদি দেখি :
বিহারী : রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ–রূপ উছলিয়া পড়িতেছিল–শরতের চন্দ্র ষোল কলায় পরিপূর্ণ। অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কিন্তু বৈধব্যের অনুপযোগী অনেকগুলি দোষ তাহার ছিলো। দোষ, সে কালো পেড়ে ধুতি পরিত, হাতে চুড়ি পরিত, পানও বুঝি খাইত। এদিকে রন্ধনে সে দ্রৌপদীবিশেষ বলিলে হয়; ঝোল, অম্ল, চড়চড়ি, সড়সড়ি, ঘণ্ট, দালনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত। আবার আলেপনা, খয়েরের গহনা, ফুলের খেলনা, সুচের কাজে তুলনারহিত। চুল বাঁধিতে, কন্যা সাজাইতে পাড়ার একমাত্র অবলম্বন…
মহেন্দ্র : এবং এইসব গুণাবলির জন্য অবশেষে তাহাকে মরিতে হইল।
মহেন্দ্রের মা : তা বিধবা অশুচি করে বেড়াবে, ভগবান তাকে শাস্তি দেবে না?
মহেন্দ্র : ভগবান এত সহজে মৃত্যুদণ্ড দেয় না মা, হাকিম দেয়। বঙ্কিমবাবু হাকিম ছিলেন জানো তো?
মহেন্দ্রের মা : নবেল লিখলে ওরকম একটু সাজিয়ে লিখতে হয়। আমাদের মতো ছা-পোষা একাদশী করা বিধবাদের নিয়ে গপ্পো লিখলে আজকালকার ছেলেদের মন উঠবে?
মহেন্দ্র : আজকালকার ছেলেদের মন এমনিতেও উঠবে না। বঙ্কিমচন্দ্রের একটাও মেয়ে ইংরেজি জানে না।…
এই সংলাপটুকু থেকেই বিশ শতকের শুরুতে মানুষের মনস্তত্ত্ব অনেকটা অনুভব করা যায়। বিধবাদের রূপ-গুণ নিয়ে, তাদেরকে নিয়ে লেখা উপন্যাসেও মানুষের বিশেষ আগ্রহ আছে, কিন্তু বিধবারা যদি অন্য রকম জীবনের স্বপ্ন দেখে তবে আবার সমাজ অশুচি হয়ে যায়। একদিকে নারীদেরকে শিক্ষিত করে তোলার পিছনে প্রবল আপত্তি, আবার ইংরেজি জানা মেয়েদের প্রতি শিক্ষিত তরুণদের গভীর আগ্রহ। কৌস্তভ বকশিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ এ বিষয়ে তাঁর নিজের অনুভবটি বলেছিলেন এভাবে :
মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে তোলার পিছনে পুরুষের আসল উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে আরও ভালোভাবে সেবাদানের কাজের জন্য প্রস্তুত করা। নির্মম সত্য হলো, যে সব মেয়েরা স্বাধীন হতে চেয়েছে, তারা আরও বেশি পুরুষতন্ত্রের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে।
‘চোখের বালি’র শুরুতেই বিধবা বিনোদিনীর সাথে আমরা পরিচিত হতে শুরু করি। উপবাস-একাদশীসহ নানাবিধ আচারের দহনে দগ্ধ হয়ে এই বিনোদিনী দমে যায়নি। ভীতি-আতঙ্ক-কুণ্ঠা বা সংকুচিতভাব তার মাঝে পরিলক্ষিত হয় না, বরং সে অনেক বেশি সাবলীল এবং জীবনপিয়াসী। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সে লুকিয়ে চকলেট খেতে দ্বিধা করে না, পুরুষের সামনে সে সাবলীলভাবে কথা বলে। চলচ্চিত্রের প্রথম অর্ধে ঋতুপর্ণ বিনোদিনীর বেদনাগুলোকে পরিস্ফুটিত করতে চেয়েছেন। আশালতার বিবাহিত জীবনের খণ্ড খণ্ড আনন্দরূপ তার হৃদয়ে যে করুণ আলোড়ন তোলে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। দুজন নারীর একজন আলতা পায়ে লালপেড়ে শাড়ি পরে উল্লসিত জীবন পার করছে, অন্যদিকে সাদাথান পরা সমবয়সী অপর নারীটির জীবনে কোনো উৎসব নেই, আনন্দ নেই। বিধবার বেদনার অন্য মাত্রাগুলোকেও চলচ্চিত্রে এনেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যেমন, এক আচার পালনের দিনে বিনোদিনীর মাসিক হয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। তরুণী বিধবার পুরুষের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ, তবে সন্তানধারণের সক্ষমতা বহনের চিহ্ন নির্দিষ্ট সময় পরপর কীভাবে তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, সেই বেদনাটুকু দর্শক হৃদয়ে জাগানোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় এই দুঃসাহসী দৃশ্যে।
বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকলেও রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোতে সে সময়ে নানা অনাচার ঘটতো। বিধবারা কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়লে গোপনে তার গর্ভপাত করিয়ে ফেলা, কিংবা দূর কোনো তীর্থস্থানে ফেলে আসা, ক্ষেত্রবিশেষে বিধবা নারীটিকে মেরে ফেলার মতো নৃশংসতাও কম ঘটতো না। সামাজিক শুচিবোধের দায় শুধুমাত্র নারীর ছিলো, পুরুষের জন্য কোনো নিয়ম ছিলো না। এই কুৎসিত দিকটিও চলচ্চিত্রে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বিনোদিনীর হাত কেটে গেলে মহেন্দ্র যখন তাকে নিয়ে রাতে ইংরেজ ডাক্তারের বাড়িতে যায়, তখন পুরুষের সাথে বিধবা নারীকে দেখে ডাক্তার সাথে সাথেই ধারণা করে নেয়, গর্ভপাত করাতে হবে।
একটা সময় এবং সমাজকে ধারণ করার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’কে এভাবে আপন ভঙ্গিতে বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
৪.
চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমরা বিনোদিনীকে ক্রমশ শরীর সর্বস্ব হয়ে উঠতে দেখি। তার বেদনার ভাষার থেকে এক সময় দেহের ভাষাই মুখ্য হয়ে উঠতে থাকে। তার মানসিক দুর্বলতা বিহারীর প্রতি, অথচ আশালতার প্রতি ঈর্ষাবশত মহেন্দ্রের যৌন আকর্ষণকে সে উপেক্ষা করে না। এমনকি এক রাতে বিহারীর কাছে উপস্থিত হয়ে সে নিজেকে নিবেদন করে বলে ওঠে :
আমি নিজের সাথে অনেক লড়াই করে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে নাও। আমাকে দেখতে ইচ্ছা না করে, চোখ বুজে থেকো। আমি কিচ্ছু মনে করবো না।
বিহারী প্রত্যাখ্যান করে বলে ওঠে, ‘আপনার সাথে তো আমার কত মধুর স্মৃতি ছিলো। সবটাকে একসাথে নষ্ট করে দিলেন!’
বিধবা নারীর পুরুষের প্রতি এমন মরিয়াভাবে আকর্ষিত হয়ার দিকটি হয়তো খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়, তবে বিনোদিনীর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন রূপটি এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে বিহারীকে লেখা একটি চিঠিতে অবশ্য বিনোদিনীর মনস্তত্ত্ব আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে :
বিধবার গায়ে গহনা দেখিয়া আপনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা বাক্য আমাকে সাহস যোগাইয়াছিল। নিজের অজান্তে কখন যে সে সাহস দুঃসাহসে পরিণত হইয়াছে এবং আপনার কাছেই হতভাগিনীকে টানিয়া আনিয়াছে, তা সত্যিই আমার অগোচর।…সে অভিজ্ঞতা আপনাকে আনন্দ দেয় নি বলিয়া আমি সত্যিই লজ্জিত।
সমাজে আমার তিনটি পরিচয়–বিধবা, মেমসাহেব এবং যুবতী। সততই এই তিন পরিচয়ের আড়ালে আমার আসল পরিচয় ঢাকা পড়িয়া থাকে। যুবতী-মেমসাহেব-বিধবাও যে সাধারণ রক্তমাংসের নারীও হইতে পারে, সমাজ তাহা স্বীকার করে না। আজ সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচে বলিতে পারি যে, আমি চতুর্থ পরিচয়টি আমি কেবল আপনার সাহসের মাঝে সন্ধান করিয়াছি।
একটা ভুলের মধ্য দিয়ে যেয়ে বিনোদিনী যেন ক্রমশ নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করে। এই চলচ্চিত্রে ‘নারীর বিরুদ্ধে নারী’র ঈর্ষাবোধের গতানুগতিক চিত্রায়ণের বাইরে মহেন্দ্র-বিহারী চরিত্রদ্বয়ের মাধ্যমে ‘পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষে’র ঈর্ষাবোধও ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
চলচ্চিত্রে সাধারণত পুরুষের চোখে নারী দেহকে দেখানো হয়। এর বাইরে নারীরাও যে পুরুষ দেহের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারে তা প্রায়শ উপেক্ষিত হয়। ‘চোখের বালি’তে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ধারণার বাইরে এসে দুটোই একসাথে আনার চেষ্টা করেছেন। বিহারীর উন্মুক্ত পিঠ কিংবা কাশীর ঘাটে মুগুর ভাজতে থাকা পুরুষদের বলিষ্ঠ দেহের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকা বিনোদিনীকে যেমন দেখিয়েছেন, আবার ঐশ্বরিয়া রাইকে বিনোদিনী রূপে হাজির করার মধ্যেও দর্শক টানার বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়।
বাংলায় কথা বলতে সক্ষম এমন কাউকে বিনোদিনী চরিত্রে না নিয়ে বলিউডের সুপরিচিত অভিনেত্রী এবং বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাইকে নেয়ার পেছনে কাজ করেছে পুরুষতন্ত্রের যৌন মনস্তত্ত্ব ব্যবহারের প্রচেষ্টা। ঐশ্বরিয়া রাইয়ের শাড়ির আঁচল বারবার খসে পড়া, উন্মুক্ত কাঁধ পিঠের প্রদর্শন কিংবা গহনায় অলংকৃত রূপ সব শ্রেণির দর্শককে অবশ্যই এক ধরনের দর্শনগত পরিতৃপ্তি প্রদান করে। এর পাশাপাশি বিছানায় শায়িত অবস্থায় আশালতা ও মহেন্দ্রের অন্তরঙ্গ কথোপকথন, সিঁদুরের লাল রঙা মাখা দুজনের মুখ অথবা দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে আশালতা ও বিনোদিনীর কথোপকথনজুড়ে যৌন সুড়সুড়ির উপাদান প্রবেশ করিয়ে চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সফলতার দিকটিতে নজর দিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি খুব নিশ্চিতভাবেই জানতেন, তাঁর চলচ্চিত্রের এসব উপাদান ‘অশ্লীলতা’র বাইরে যৌনতার ‘শৈল্পিক’ রূপ হিসেবে গণ্য হবে এবং তাই-ই হয়েছে।
এই কারণেই প্রথমবারের বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনকে হাজির করা হয়েছে এবং সত্যি বলতে তার পাশে আশালতা চরিত্রে রাইমা সেন রীতিমত ম্লান হয়ে গেছে। সরলতাপূর্ণ কথা বলতে থাকা আশালতা চলচ্চিত্র জুড়ে উপস্থিত থাকলেও ঐশ্বরিয়া রাই–ই দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রস্থলে থেকেছে।
চলচ্চিত্রে যৌন সুড়সুড়িদায়ক উপাদান রাখা একটা পুরনো পন্থা এবং দর্শকের যৌন মনস্তত্ত্বকে মাথায় রেখে বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতারা এটা নিয়মিতভাবেই করে আসছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ বাণিজ্যিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক–এই দুই ধারার মধ্যে সমন্বয়সাধনকারী একজন নির্মাতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো একই সাথে ব্যবসা সফল এবং শিল্পগুণসম্পন্ন। তবে বাণিজ্যিক সফলতার জন্য ‘চোখের বালি’তে নারীদেহের এই অতি ব্যবহার ঠিক যেন ঋতুপর্ণসুলভ নয়। আবার মুসলমানদের কোনো ধরনের উপস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের সূচনা এবং সমাপ্তিতে আজানের ধ্বনি সংযোজন করে অসাম্প্রদায়িক চিত্র আনার প্রয়াসও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
তাই বলে দৈহিক ভাষার আড়ালে বিধবা বিনোদিনীর বেদনার ভাষা যে চাপা পড়ে গেছে, সেটি বললেও অন্যায় হবে। বিধবা বিনোদিনী মনস্তাত্ত্বিক রূপটিও সমানতালে চলচ্চিত্রে এসেছে।
৫.
মহেন্দ্র বিনোদিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছে, তার জন্য ঘরবাড়ি-স্ত্রী ছেড়ে কাশীতে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু বিনোদিনী পেতে চেয়েছে বিহারীকে। এদিকে বিহারী যেহেতু আশালতার প্রতি অনুরক্ত, কাজেই আশালতার স্বামী মহেন্দ্রকে নিজের কাছে রেখে সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
এখানে চারজন নারী-পুরুষের একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কেউ কাউকে পাচ্ছে না। মহেন্দ্র চেয়েছে বিনোদিনীকে, বিনোদিনী চেয়েছে বিহারীকে, বিহারী দুর্বল আশালতার প্রতি, আশালতার দুর্বলতা তার স্বামী মহেন্দ্রের প্রতি। রবীন্দ্রনাথ এই চক্রের আকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন মহেন্দ্র-আশালতার পুনর্মিলন, বিহারীর মানবসেবা ব্রত এবং বিনোদিনীর কাশীগমনের মাধ্যমে।
অন্যদিকে ঋতুপর্ণ তাঁর স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন ভিন্নভাবে। মায়ের মৃত্যু এবং স্ত্রী আশালতার গর্ভধারণের সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্র চলচ্চিত্রেও নিজের বাড়িতে ফেরত গেছে। বিহারী বিনোদিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বিনোদিনী তাতে সরাসরি আপত্তি জানায়নি। শুধু বিয়ের দিন সকালে একটি চিঠি রেখে সে হারিয়ে গেছে। চিঠিটা আশালতার উদ্দেশ্যে :
ভাই বালি,
…মনে পড়ে? তুই বারবার জিজ্ঞেস করতিস, দেশ কি? পিসীমার দেশের বাড়ি আর মকবুলের দেশের বাড়ি আলাদা কেন? বিহারীবাবু যে দেশের কাজ করেন, সে কোন দেশ? তোর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পরে সেই চিন্তা আমাকে বড় ভাবিয়েছে রে। তোর আর আমার মধ্যে বাইরে অনেক অমিল ছিল। তবুও আমরা সই পাতিয়াছিলুম। বেশ ছিলুম দর্জিপাড়া স্টেটের দোতলার অন্তপুরে। সেটাই ছিল আমাদের রোজকার জগত। যদি ‘দেশ’ বলতে চাস তাও বলতে পারিস। অমন বাইরের অমিল নিয়ে মিলেমিশে থাকাটা এদেশে নতুন নয়। তাই আমরাও নতুন কিছু করিনি, বালি।
তাই বলে অন্তরের মিল বলতে সত্যিই কি কিছু ছিল না? ছিল। সংসার করার সাধ; ওই যে বললুম ওই দর্জিপাড়ার স্টেটের অন্তপুরের বাইরে আমরা আর কিচ্ছু দেখি নি। তাই আমাদের দেখা একটা মানুষকে নিয়ে দুজনেই সেই সাধ মেটাতে চেয়েছি। তাতে সাধও মেটেনি, আমাদের ছোট্ট দেশটুকু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কার্জন সাহেবের আইন সত্যিই যদি ফলে, তবে এখন থেকে তুই আর আমি আলাদা দেশে থাকব। সেই দুই দেশে বসে আমরা যদি নিজে নিজে এত দিনকার অপমান, দুঃখ আর বঞ্চনার কথাই কেবল ভাবি, তাহলে তো আমরা প্রথম থেকেই হার মেনে নিলুম। আসলে দেশ তো মনের মধ্যে বালি।
…যেদিন ওই দর্জি পাড়ার স্টেট ছেড়ে কাশী ঘাটে গিয়ে দাড়ালুম, সেদিন প্রথম জানলুম সত্যিকারের দেশ কাকে বলে! সেখানে হেঁশেল, উঠোন, খড়খড়ি, এঁটো শকড়ির বাইরেও যে একটা বিরাট জগত, সে তো আমরা বইয়ে পড়েছি রে! আর ভেবেছি গল্পকথা। মহাভারতে আছে অভিমন্যু মায়ের পেটের মধ্যেই মস্ত বীর হয়েছিল। তোর পেটে যে সন্তান, সে তোর সাথে সাথে রোজ গঙ্গা স্নান করেছে। দোহাই বালি, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তাকে কেবল ওই দর্জি পাড়ার স্টেটের দোতলার বাড়িতে আটকে রাখিস নে। দেখবি, সত্যিকারের দেশ কাকে বলে, সেই একদিন তোকে বুঝিয়ে দেবে।
অর্থাৎ ঘর-দুয়ার ও সংসারের মায়া কাটিয়ে বিনোদিনী পুরো ভারতবর্ষকে আপন করে পেয়েছে। সাধারণ কামনা বাসনার উর্ধ্বে উঠে সে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে।
সত্যি বলতে তথাকথিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক শুদ্ধতা রক্ষার দায়ে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ‘চোখের বালি’র সমাপ্তি টেনে ছিলেন, তা রীতিমত হাস্যকর বটে। সেখানে মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার সাথে বিনোদিনী কাশীবাসী হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। তাদের বিদায় নেয়ার শেষ মুহূর্তটি উপন্যাসের শেষে ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ‘বৌঠান, মাপ করিয়ো।’ তাহার চোখের প্রান্তে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া আসিল।
বিনোদিনী কহিল, ‘তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুন।’
অর্থাৎ যে বিনোদিনীর প্রেমে উন্মত্ত হয়ে মহেন্দ্র বাড়ি ছাড়া হয়েছিল, তাকেই সে প্রণাম করে ক্ষমা চাইলো। আবার অনুশোচনায় চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো। শুধু বর্তমান না, সেই অতীতের প্রেক্ষাপটেও এমন সমাপ্তি বেশ আরোপিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘চোখের বালি’র সমাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। চলচ্চিত্রের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি এজন্য ঋতুপর্ণ আমাদের দেখান। সেখানে বলা হয়েছে :
‘চোখের বালি’ বেরবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৪ জুন, ১৯৪০]
ফলে সমাপ্তিতে পরিবর্তন আনার এই পূর্ণ স্বাধীনতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ নারীর মাঝে স্বাধীনতাবোধ জন্ম নেয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে চলচ্চিত্রে যেভাবে সমাপ্তি টেনেছেন সেটিও প্রশংসনীয়।
৬.
২০০৩ সালের প্রেক্ষিতে একই সাথে বিশাল বাজেটের এবং একটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’। ‘চোখের বালি’ নির্মাণের স্বপ্নও ঋতুপর্ণ ঘোষ বয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। কাজেই তাঁর সযত্ন শ্রম এবং বিচিত্র পরীক্ষণের ছাপ লেগে রয়েছে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে।
নিজেকে সত্যজিৎ রায়ের ঘরানার একজন নির্মাতা মনে করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রিয় চলচ্চিত্রকারের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘চারুলতা’র (১৯৬৪) কিছু দৃশ্য এখানে পুনঃনির্মাণ করেছেন তিনি। চড়ুইভাতির দিন বিনোদিনী ও আশালতার দোলনায় দোল খাওয়া কিংবা অপেরা গ্লাসের সাহায্যে বিনোদিনীর দূরে দেখার প্রচেষ্টা ‘চারুলতা’য় মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনীত সেই অনন্য দৃশ্যগুলোর নিদর্শন বহন করে।
তাছাড়া এই চলচ্চিত্রে লাল রঙের ব্যবহারের কথাও আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। আশালতার লাল রঙের ব্লাউজ পরে দেখানো কিংবা পরবর্তীতে কাশীতেও বিনোদিনীর লাল রঙের চাদর পরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নির্দেশ করে। তৃষা গুপ্তাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ এ প্রসঙ্গে নিজেই বলেছিলেন :
১৯০২ সালে ‘লাল’ ছিল কামনার রঙ, কিন্তু গোটা বিশ শতক আমাদেরকে দেখিয়ে গেল যে, লাল বিদ্রোহের রঙও বটে। কাজেই ২০০৩ সালে আমি যখন লাল রং ব্যবহার করছি, তাতে কামনার সাথে বিদ্রোহকেও বোঝাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেহেতু গত ১০০ বছর দেখে যেতে পারেননি, কাজেই এখানে আমি তাঁর থেকে এগিয়ে থাকছি।
যথার্থ স্থান নির্বাচন আর আবহ সঙ্গীতের সম্মিলন একটি হারানো সময়কে অন্যরূপে ফিরিয়ে এনেছে এই চলচ্চিত্রে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের পাশাপাশি রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সূচক একটি গান এই চলচ্চিত্রে পুনঃপুন বেজে উঠেছে, ‘মাধব মিলন তরে আমার রাধা, বাসর সজ্জা করে বসি শুদ্ধ নিকুঞ্জমঞ্জিরে…।’ বিধবা বিনোদিনীর বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে এই গানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মূল অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি দুজন ডাবিংশিল্পীর কণ্ঠের সুনিপুণতার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। এই চলচ্চিত্রে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের কণ্ঠ দিয়েছেন শ্রীলা মজুমদার এবং রাইমা সেনের কণ্ঠ দিয়েছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তাদের কণ্ঠের জাদুতে ‘চোখের বালি’ আলাদাভাবে প্রাণ পেয়েছে।
আক্ষরিক অনুবাদে ‘চোখের বালি’কে ‘Sand in the Eye’ কিংবা ‘Eyesore’ রূপে অনুবাদ করা যায়, তবে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই চলচ্চিত্রের ইংরেজি টাইটেল দিয়েছেন ‘A Passion Play’। অর্থাৎ নিষিদ্ধ কামনার উপস্থাপনকেই তিনি এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকেন্দ্র রূপে বিবেচনা করেছেন। এই নামেই হিন্দিতে ডাবিংয়ের পর চলচ্চিত্রটির আন্তর্জাতিক মুক্তি ঘটে।
‘বাংলা ভাষায় নির্মিত শ্রেষ্ঠ কাহিনীচিত্র’ হয়ার পাশাপাশি আরো দুটি বিভাগে ২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে ‘চোখের বালি’। এছাড়া ২০০৩ সালে লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন লেপাডে’র (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র) জন্যও মনোনীত হয়েছিল চলচ্চিত্রটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে এই ভিন্ন রূপ অথচ অনন্য উপস্থাপনটি ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সময় এবং সমাজের পরিপূর্ণ চিত্রায়ণ হিসেবে ‘চোখের বালি’র আবেদন সামনের দিনগুলোতেও সমানভাবে অক্ষুণ্ন রইবে।
ঋণস্বীকার :
১. Ghosh, Rituparno (2005). Interview, Rituparno Ghosh and the ‘Intellectual Film’ in India— Asia Society. http://www.asiasociety.org/arts-culture/film/rituparno-ghosh-andintellectual-film-india//
২. Bakshi, Kaustav (2011). ‘Chokher Bali: Unleashing Forbidden Passions’. Silhouette: A Discourse on Cinema.
৩. শরমিন, মনিরা (২০১১)। ‘সুশীল রুচির শিল্পিত মোড়কে আবৃত ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র ‘চোখের বালি’তে রুচি ও যৌনতার প্রশ্ন।‘ নারী ও প্রগতি।
৪. Chakraborty, Aishika (2012). ‘Playing Passion Over Penance : Re-viewing Chokher Bali (1902-2002)’, Silhouette : A Discourse on Cinema.
৫. Macdonald, Alison (2009). ‘Real’ And ‘Imagined’ Women : A Feminist Reading of Rituparno Ghosh’s Films.’ UCL.