Pratiswik
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
Pratiswik
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
বিজ্ঞাপন
ADVERTISEMENT
হোম গল্প
কেঁদেও পাবে না তাকে

কেঁদেও পাবে না তাকে

রিফাত আনজুম পিয়া রিফাত আনজুম পিয়া
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
বিভাগ : গল্প
167
Views
ফেসবুকটুইটারহুয়ার্ট্সঅ্যাপলিংকইন্ডই-মেইল

‘মৌ কাল সকালে চলে যাবে গো।’

প্রায়ান্ধকার গোসলখানায় কুঁজো হয়ে থাকা মতিউরের পিঠে ধুন্দলের ছোবড়া দিয়ে সাবান ঘষতে ঘষতে শীতের করুণ হাওয়ার সুরে বললো ঝরনা। কথাটা মন্ত্রের মতো, কিংবা বলা যায় বৈদ্যুতিক শকের মতো কাজ করলো—মতিউর স্প্রিংয়ের মতো চমকে উঠলো। বাইরে থেকে তার চমকানি ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেলো না। ভেতরে ঢোকা গেলে দেখা যেতো একটা সর্বপ্লাবী চাঞ্চল্য বয়ে গিয়ে মতিউরের কোষে কোষে জমে থাকা কুয়াশার মতো অবসাদ তাড়িয়ে দিলো, যেমন ঝরনার মগের পানিতে তার গায়ের সাবান-ফেনা ধুয়েমুছে যাচ্ছিলো।

ঠিক কবে মাথাটা একটা ভারী কুয়াশাচ্ছন্ন গোলকে কিংবা গোলকধাঁধায় পরিণত হলো ঠাওর করতে পারে না মতিউর। সেখানকার ঘটনাবলির কোনো স্পষ্ট বিবরণ সে দিতে পারবে না। কখনো ধু ধু মরুর মতো খাঁ খাঁ শূন্যতা, কখনো শয়ে শয়ে খেই হারানো কুণ্ডলী পাকানো চিন্তা যেন অগুনতি কিলবিলানো সাপ, কখনো দুর্বোধ্য কার্যকারণহীন এখান থেকে ওখান থেকে জোড়া লাগানো ছবির কোলাজ, কখনো প্রচণ্ড বিস্ফোরন্মুখ খুলিফাটা অক্ষম রাগ।

ঝরনার মুখে কথাটা শুনে মতিউরের মনে হলো সে রিপ ভ্যান উইঙ্কল। দীর্ঘ নিদ্রা শেষে সবে জেগে উঠেছে। মেয়েটা কাল চলে যাবে! এই সেদিনই না বাড়ি এলো দূরের শহরের বোর্ডিং থেকে। এর মধ্যে উনিশটা দিন কাবার! মতিউর বড়োজোর চার-পাঁচ দিনের কথা স্মরণ করতে পারে। দুমাসের ওপর সে শয্যাশায়ী, তার কয়দিনেরই বা হিসাব দিতে পারবে? শুরুর দিকে রাগ, ক্ষোভ, অভিমানের ঘূর্ণিপাকে পলকা নৌকার মতো ওলটপালট হচ্ছিলো। সারাদিন খিটখিটে মেজাজ; ঝরনার ওপর অযথা চোটপাট। রাত ঘন হলে ছেঁকে ধরতো মৃত্যুর ছায়া। কোনো কোনোদিন ভাবত বুঝি মরে গেছে। অনন্তকালের চরম নিঃসঙ্গতায় বন্দি আত্মার মতো কেঁপে উঠতো তখন। সেই সব নিদ্রাহীন ছটফটানো রাতে অসহায় তিক্ত কান্নায় বুকের ভার নিংড়াতে গিয়ে সে বুঝে গেছিলো হাজার রাতেও এই ভাঁড়ার খালি হবে না। তারপর ডাক্তার কড়া ডোজের কী কী সব ওষুধ দিলেন। ধীরে ধীরে গাঢ় কুয়াশায় আচ্ছন্ন হলো মাথা; নিজের কাছেই আবছা, ঝাপসা হয়ে গেলো সে। দুঃখ কী? আনন্দ কী? নবজাতকদের মতো রাত-দিনের তফাত ঘুঁচে গেলো। যেন কখনো পুরোপুরি ঘুমায় না সে, যেমন পুরোপুরি জেগে থাকে না কখনো।

দুই.

আধা-সামরিক বোর্ডিং স্কুলে তিন মাস কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিল মৌমিতা।

বরাবর বোর্ডিংয়ের চৌহদ্দি পেরোনো মাত্রই তার পাখনা গজাতে থাকে। খাকি ইউনিফর্ম খোলা মাত্র রোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় রঙের রেণু ঢুকে যায়—প্রজাপতির মতো ফুরফুরানি শুরু। ওই বিশ-বাইশটা দিন মতিউর-ঝরনা মেয়ের চারপাশে ভনভন করে। অফিস থেকে তড়িঘড়ি ফেরে বারান্দায় তিনজনে চা খাবে বলে। বাড়িতে রোজ বিশেষ রান্নাবান্না হয়। ঝরনা মেয়েকে নিয়ে পাড়া বেড়ায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘোরে। মতিউর মেয়েকে মোটরসাইকেলের পেছনে চাপিয়ে বইয়ের দোকানে যায়; ফেরার পথে কোন কনফেকশনারির সামনে বাইক থামিয়ে বাপ-বেটিতে আইসক্রিম খায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে কখনো কখনো মতিউরের বুক হু হু করে ওঠে—আহা রে, এই যে মৌ বাড়ির বাইরে পা রাখল মাত্র বারোতেই—যেন গর্ভস্থ শিশু বেরিয়ে গেছে…আর ঢুকবে না ভেতরে। বোর্ডিং থেকে পাশ করে দূরের কোনো ভার্সিটিতে…তারপর চাকরি-সংসারের টানে হয়তো আরও দূরের শহরে…দুই-দশদিনের অবসরে বাপমায়ের কাছে আসবে, অতিথির সমাদরে থাকবে, তারপর অতিথি পাখির মতো নিজ গন্তব্যে উড়াল দেবে।

এবার বাড়িতে পা রেখেই মৌমিতা বুঝে গেছে কিছুই আগের মতো নেই। দমবদ্ধ মরামরা ভাব। মা শুকিয়ে গেছে, চোখের তলায় কালি, রংজ্বলা কাপড়ের মতো মলিন মুখ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কথা শুরু হয় না, শেষ হয় না। মতিউরের অসুস্থতার খবর সে পেয়েছিল, কিন্তু বাবা যে একেবারে বিছানা নিয়েছে সে খবর তাকে কেউ দেয়নি। বাপ-মায়ের ঘরে ছুটে গিয়ে দেখল শুকিয়ে ওঠা-নেতিয়ে পড়া ময়লাটে একটা শরীর বিছানায় পড়ে আছে, যে তাকে দেখে খুশি হল না, একটুও হাসল না, নিজ থেকে একটা কথাও বললো না। মৌমিতা অনেক কষ্টে ঢোক গিলে গিলে কান্না গিলে ফেললো। অন্যবার মা তাকে জড়িয়ে ধরে, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা শরবত বের করে দেয়। বাবার চোখেমুখে খুশির বাতি জ্বলতে থাকে। ঝরনা দেখো তো, মৌ আগেরবারের চেয়ে লম্বা হইছে নাকি? এই টার্মে কী কী হইলো মা? আমাদের ছেড়ে থাকতে এখনো কষ্ট হয়? বাম হাতের বুড়া আঙুলে কী হইছে! ভলিবল খেলতে গিয়ে চোট পাইছো? ব্যথা আছে এখনো? কী কী বই পড়লা এবার?

সেই বাবা…। নিজের ঘরে ঢুকে মৌমিতা দেখলো কেউ ডিটারজেন্টের গন্ধঅলা সদ্য কাচা পরিষ্কার চাদর বিছানায় পাতেনি। লাগোয়া বাথরুমটা কেউ ঝকঝকে তকতকে করে রাখেনি। রান্নাঘরে মা খাবার গরম করছিল। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘আম্মু, আব্বুর এই অবস্থা কেন! তোমরা তো আমাকে জানাওনি!’, বলতে বলতে মৌমিতার গলা ধরে আসে।  

ঝরনা মেয়েকে বেশি কিছু জানতে দিতে চায় না।

‘তোমার আব্বুর শরীরটা একটু দুর্বল। এনজিওপ্লাস্টির পর বেশিদিন রেস্ট না নিয়েই অফিসে জয়েন করছিল তো। ডাক্তার এখন বেডরেস্টে থাকতে বলছে।’

‘কতদিনের ছুটি নিছে?’

ঝরনা আপনমনে বলতে থাকে, ‘ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো। সেকেন্ড অপিনিয়ন নিয়ে দেখি। মেডিকেল ভিসা পাওয়া যাবে না, ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করছি।’

‘এত কিছু হয়ে গেছে, চিঠিতে কিছু লিখো নাই কেন?’

ঝরনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে—‘খামাখা তোমার টার্মটা খারাপ যাইতো।’

তিন.

রোজ সকালে ঝরনার অফিস। ফিরতে পারে অবশ্য দুপুরের পরপরই। তার বস লোকটা খিটখিটে হলেও অসুস্থ স্বামীর জন্য ছুটি মঞ্জুর না করার মতো নির্দয় না। এতদিন মতিউর একলা থাকতো। অসুস্থ মানুষ, একদম একলা রেখে গেলে বুকের ভেতর ঘুরে ঘুরে কু-ডাক বাজতে থাকে। একা থাকতে থাকতে লোকটা যেন কথা বলাই ভুলে গেছে। এখন মেয়ে আছে বলে ভরসা।

ঘুম থেকে উঠেই বাবার সাথে আলাপ জমানোয় লেগে পড়ে মৌমিতা। একসময় খবরের কাগজের আগাগোড়া প্রায় মুখস্থ করত মতিউর। এখন ছুঁয়েও দেখে না। মেয়ে রুটিনমাফিক খবরের কাগজ মেলে ধরে পড়ে শোনায়—

আঙ্গেলা মেরকেল জার্মানির প্রথম মহিলা চ্যান্সেলর

গতকাল বার্লিনে জার্মান সংসদ বুন্দেস্টাগ প্রথম মহিলা চ্যান্সেলর হিসেবে সিডিইউ প্রধান আঙ্গেলা মেরকেলকে নির্বাচিত করেছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে এসপিডি এর চেয়ারম্যান মাথিয়াস প্লাতসেক আগামী চার বছর তার দলের সহযোগিতার কথা বলেন।

বাবার চোখেমুখে আগ্রহ না দেখে সে ভেতরের পাতায় চলে যায়। শেষ কলামের ছোট্ট বক্সে জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারার এক বৃদ্ধের ছবির নিচের লেখাটা পড়ে—

নীরদ সি চৌধুরীর ১০৮তম জন্মবার্ষিকী

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও মননশীল লেখক নীরদ সি চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে। তিনি…

‘আর না।’ পাশ ফিরে শোয় মতিউর।

কাগজ ভাঁজ করে বাপের কাঁধের খসখসে চামড়ায় হাত রাখে মৌমিতা। নাকে ধাক্কা দেয় ভ্যাপসা অসুখ অসুখ বাসি গন্ধ।

‘আব্বু, চলো, বারান্দায় বসে গল্প করি। তোমার গায়ে রোদ লাগানো দরকার।’

মতিউর মাথা নেড়ে না করে দেয়।

‘এই যে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকো, দমবন্ধ লাগে না? বারান্দায় গিয়ে বসলে, ওয়াকিং স্টিকটা ধরে একটু হাঁটাহাঁটি করলে শরীরটা ঝরঝরে লাগতো না বলো?’

মতিউর চোখ বুঁজে ফেলে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চাপা স্বরে বলে, ‘শক্তি নাই।’

মৌমিতা দমে যায়। বাবাকে কীভাবে সচল রাখা যায়? হাত না হোক, পা না হোক, অন্তত মনটা। চোখ বন্ধ থাকলেও মানুষটার কান তো খোলা।

গত টার্মে উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নিতে রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপনমনে বকবক করত সে। সেই অভ্যাসে মুখ চলতে থাকে—

‘জানো আব্বু, এবার ইংরেজি উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আমার টপিক ছিলো ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’। শুরুতে আমি লাইফের ছোটো ছোটো আনন্দগুলো নিয়ে বলছি। এই যে, তোমাদের সাথে বারান্দায় বসে চা-খাওয়া…গরমের দিনে ছাদে শুয়ে আকাশের তারা দেখা…বইয়ের গন্ধ শোঁকা…আবার ধরো জগতের রহস্য, টেলিপ্যাথি, সম্পর্কের টান – আমার যেদিন জন্ম হয়, তার আগের দিন তোমার মনে হচ্ছিলো, কালই তোমার মেয়ে দুনিয়ায় আসবে। ঢাকায় ট্রেনিং চলতেছিল তোমার, তুমি ছুটি নিয়ে চলে আসছিলা…আর তোমাকে দেখার পর আম্মুর লেবার পেইন উঠলো…তার তিন ঘণ্টা পর আমি দুনিয়ায় আসলাম…এই রহস্যময় সংযোগের ব্যাখ্যা কী? জাস্ট কাকতালীয় ভাবতেও ইচ্ছা হয় না…জীবনটা রহস্যময় সুন্দর…’

শ্রোতার সাড়া না পেয়ে মৌমিতা বোঝার চেষ্টা করে বাবা ঘুমিয়ে গেলো কিনা। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস তার কানে আসে, সেটা ঘুমন্ত না জাগ্রত মানুষের কে বলবে!  

কোনো কোনো দিন সে বাবাকে ধ্যান করতে সাধাসাধি করে—‘আব্বু, জানো, মেডিটেশন নাকি অনেক হেল্প করে। পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ ইস্যু করে আনছি, দেখো।’ কেমন করে শ্বাসপ্রশ্বাসের আসাযাওয়া খেয়াল করতে করতে অন্তঃস্থলে ডুব দিয়ে দেহ-মনের ওপর কর্তৃত্ব করা যায়, মহা উৎসাহে পড়ে শোনায়—যেন আব্বুর কানে গেলেই অর্ধেক অসুখ সেরে যাবে। কোনো কোনো দিন ডেল কার্নেগীর রচনাসমগ্র নিয়ে বসে। বইটা বছর দেড়েক আগে বাবাই কিনে দিয়েছিল। বোর্ডিং স্কুলে মৌমিতার তখন দিশেহারা অবস্থা। জন্ম থেকেই সে লাজুক, চুপচাপ। জাত অমিশুক যাকে বলে। ঝরনা স্কুলমাঠে খেলতে থাকা বাচ্চাদের হাতে লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে মৌমিতাকে ভিড়িয়ে দিতো। তবে লজেন্সের প্রভাব বেশিক্ষণ থাকতো না। পরদিন আবার তাকে ক্লাসরুমের এক কোনায় একা পাওয়া যেতো। এমন গোটানো স্বভাব সত্ত্বেও আপনাআপনি দুচারটা বন্ধু জুটে গেছিলো। হুট করে তাদের ছেড়ে, বাপমা ছেড়ে অন্য শহরের আধা-সামরিক বোর্ডিংয়ে একার জীবন; কড়া নিয়মকানুন, পিটি-প্যারেড আর ওপরের ক্লাসের মেয়েদের হাতে নাজেহাল হতে হতে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের মতো নাজুক অবস্থা তখন; বাড়ির জন্য রোজ কান্নাকাটি। সোজাসুজি ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও’ লিখলে সে চিঠি পোস্ট হবে না। মুখস্থ ‘আমি ভাল আছি’ লিখতে গিয়ে তার চোখ ভেসে যেতো। নরম-সরম, আনাড়ি-অপটু, লাজুক মেয়েটাকে বোর্ডিং স্কুলই শক্তপোক্ত করে গড়েপিটে নেবে বলে বিশ্বাস করত ঝরনা। মতিউর শুধু বোর্ডিংয়ের ওপর ভরসা করতে পারতো না। প্রতি সপ্তাহে বিশাল বিশাল অনুপ্রেরণাদায়ী চিঠি পাঠা্তো। (ক্লাসের মেয়েরা সেই চিঠি পড়তে নিয়ে মৌমিতার বন্ধু বনে গেছিলো) সে সময়ই ডেল কার্নেগীর রচনাসমগ্র কিনে নীল সাইন পেনে দাগিয়ে দাগিয়ে মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল মতিউর। দেড় বছর পর মৌমিতা যে উপস্থিত বক্তৃতায় টানা ৫ মিনিট বকবক করতে পারল তা কার্নেগী সাহেবের নানাবিধ কায়দা-কৌশলে না বোর্ডিংয়ের শক্ত ছাঁচে নতুন আকার পেয়ে না মতিউরের চিঠির কেরামতিতে তা সে নিজেও জানে না। তবে এবার অসুস্থ বাপকে সাহস দিতে তার ঢাউস বইটাকে মনে পড়ে।

‘আব্বু, এই যে এখানে আছে…একটা লোকের পাকস্থলীর ক্যান্সারে মরমর দশা। মৃত্যুর আগে জীবনটাকে উপভোগ করতে সে ডাক্তারদের বিধিনিষেধ না মেনেই জাহাজে চড়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। হতাশা-দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নির্ভেজাল আনন্দ খুঁজেছিল। ভ্রমণ শেষে সে যখন আমেরিকায় ফিরলো, দেখা গেলো তার অসুখ একদম গায়েব! এই যে আনন্দের মধ্যে অসুখের নিদান খুঁজে পাওয়া, মনের শক্তি দিয়ে রোগ জয় করা…তোমাকেও বিশ্বাস করতে হবে…’ বলতে বলতে মেয়ে বাপের দিকে চায়। মতিউরের মুখ একদম ভাবলেশহীন। মৌমিতার মনে হয়, কথাগুলো ওই সাদা দেয়ালের মতো শূন্য মুখে ধাক্কা খেয়ে তার কাছেই ফিরে এলো। বাবা বিছানার কাঁথা-বালিশের মতো নিঃসাড় হয়ে গেছে। এই যে রোজ সকালে অফিস যাওয়ার আগে মা সিথানে রাখা হাদিসের বই আর তসবিহ দেখিয়ে বলে, ‘মৌয়ের আব্বু! একটু আল্লাহর নাম নিও গো! খালি আমরা নামায পড়ে দোয়া করলে হবে? তোমার নিজেরও তো আল্লাহর কাছে চাওয়া লাগবে!’, সে কথা বাবার চোখে-মুখে কোনো ছায়া ফেলে না।

দিন কয়েকের মধ্যে ডেল কার্নেগী পড়ে শোনানোটা মৌমিতার কাছে বড়ো একঘেয়ে ঠেকলো; হাই উঠতো একটু পর পর। মনে হতো এসব কোনো কাজের তো না-ই, বরং কেমন হাস্যকর।

সকালসকাল বাবার ঘরে যাওয়াটা বাদ দিয়ে দিলো সে। একটা ময়না পাখির সামনে এ্যাদ্দিন বকবক করলেও ওটা কথা বলা শিখে যেতো! এই গম্ভীর গোমড়া লোকটা তার আব্বু না। আব্বুর মতো দেখতে একটা শরীর মাত্র— গোসলখানার শুকনো ধুন্দলের ছোবড়ার মতো, যার ভেতরের জলীয় শাঁস সব শুকিয়ে গেছে। দিনরাত এই মরা খোলস দেখতে দেখতে জলীয় শাঁসের স্বাদও সে ভুলে গেলো প্রায়। আব্বুর হাসিহাসি ভালমানুষ চেহারাটা, আব্বুর আদরের যত মুহূর্ত সহসা আর মনে পড়তো না। 

চার.

‘মৌ কাল সকালে চলে যাবে গো।’

কথাটা মতিউরের মাথার ভেতর একটানা বেজে চললো। একটা কম্পন সাঁইসাঁই করে আগাপাশতলা ঘুরতে লাগলো। হৃৎপিণ্ডে পাগলা ঘন্টার মতো ঢংঢং বাড়ি পড়তে থাকলো। এতদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা সমস্ত আবেগ যেন একযোগে ফুঁসে উঠেছে। এই বেসামাল উত্তেজনা সওয়া তার ক্ষয়িষ্ণু শরীরের পক্ষে বড়ো কঠিন, কিন্তু এ-ই আবার তাকে জাগিয়ে রেখেছে।

মতিউরের মনে হতে থাকে, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা কিছু পরম যত্নে জমিয়েছে জীবনভর, ফাঁক গলে পড়ে যাচ্ছে।

গত মাসে মৌ চৌদ্দ পেরিয়েছে। কৈশোরে মেয়েরা তরতর করে বদলায়। ওর উঠতি শরীর-মনে এখন কত কৌতূহল, কত আনকোড়া অনুভূতি। প্রতি মুহূর্তে ও অচেনা হয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে। উনিশটা দিন মতিউর পেয়েছিল। কিন্তু ওকে চিনে নিতে পারলো না। কাল ও দূরের শহরে চলে যাবে, তিন মাস চিঠি ছাড়া যোগাযোগের উপায় থাকবে না। মতিউরের কেবলই মনে হতে থাকে, এর মধ্যেই সে মারা যাবে। ছটফট করতে করতে একমাত্র কন্যাকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে না পারার অতৃপ্তিজাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার মতো করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে।

মতিউর অস্থির হয়ে ডাকে, ‘মৌ, মৌ!’

মৌমিতা ঘরে ঢোকে। সারা মুখে উপটানের পরত; শুকিয়ে চড়চড় করছে। চামড়া কোঁচকানোর ভয়ে মুখ-ঠোঁট যথাসম্ভব না নাড়িয়ে আড়ষ্টভাবে বলে, ‘কী আব্বু?’

মতিউর হাঁ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সব কথা মিলিয়ে যায়।

মৌমিতা কোন সাড়া না পেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘কিছু লাগবে?’

‘পানি।’

মৌমিতা বোঝে না পানির জন্য তার ডাক পড়লো কেন। বিছানার পাশের টেবিলে দিব্যি পানির বোতল, মগ রাখা। পানিটা বাবা নিজেই ঢেলে খায়। মতিউরের হাতে মগ ধরিয়ে দিয়ে গাল না নাড়িয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘আমি মুখ ধুয়ে আসতেছি। তোমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ায় দিয়ে কোচিংয়ে যাবো।’

আলু-ট্যাংরার ঝোল আর পুঁইশাকে প্লেটের ভাত ঢেকে ফেলে তার ওপর ডালও ঢেলে নেয় মৌমিতা—পান্তাভাতের মতো থই থই ডাল। কে বারবার রান্নাঘরে যাবে একেক বার একেক পদ আনতে?।

মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার সময় সে টের পায়, বাবা কেমন অশান্ত, কেমন অদ্ভুতভাবে তাকে দেখছে। চোখ দুটোর দিকে তাকানো যায় না এমন তীব্র চাউনি। ওর অস্বস্তি লাগে।

‘আব্বু, শরীর খারাপ লাগতেছে?’

না-সূচক মাথা নাড়ে মতিউর। তার শ্যামলা মেয়েটা মুখে উপটান লাগিয়ে উজ্জ্বল হতে চাইছে। মতিউরের মনে পড়ে, বাপের মতো ময়লা রং পেয়েছে বলে মেয়েকে নিয়ে নাখোশ ছিলো ঝরনা। মতিউর রোজ অফিস থেকে ফিরে মশারি তুলে হাঁ করে দেখত তার ঘুমন্ত কন্যাকে। ওর ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, বোঁচা নাক, পাতলা ঠোঁট, থুতনির খাঁজ, ফোলা ফোলা গাল। মেয়েটা স্বপ্নের ঘোরে হাসতো। কখনো ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক করতো, জিভ দিয়ে চেটে নিতো, কখনো ভুরু কোঁচকাতো। ঝরনা মুখ বাঁকাতো, ‘কী দেখো এত কালটি মেয়েকে?’

মতিউর বলতো, ‘এইটা আমার কালটি সুন্দরী!’

মতিউর এই ঘষে-মেজে উজ্জ্বল হওয়া মেয়েকে দেখে। তার হ্যাংলা মেয়েটার শরীর একটু একটু করে পুষ্ট হচ্ছে। এই ডাগর মেয়েটা যখন এ্যাত্তটুকুন ছিলো, নিজ হাতে সবে খাওয়া শুরু করেছিল, মাছের কাঁটা মতিউরই বেছে দিতো। মেয়ে কাঁটা বাছা শিখে গেলেও নিজের পাতের মাছ বেছে খাইয়ে দিতো কোনো কোনো বেলা। খুশিতে ওর ছোটো চোখ দুটো বুঁজে যেতো তখন—আব্বু, তুমি আমাকে এত আদর করো!

মতিউর খেয়াল করে কি যেন ভাবছে মৌ, আনমনা। যন্ত্রের মতো খাইয়ে দিচ্ছে বাপকে। বড়ো তাড়াহুড়া। যা-ই ভাবুক, সেখানে যে বাপের অস্তিত্ব নেই, তা বেশ বোঝা যায়। খাওয়ার রুচি মরে যায় মতিউরের।

‘আর না।’ বাপ এ কথা বলাতে যেনো নিস্তার পায় মেয়েটা। পানি খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে দিয়ে দ্রুত বিদায় হয়।

পাঁচ.

দুইটা বেজে গেছে! দেয়ালঘড়িতে সময় দেখে আঁতকে ওঠে মৌমিতা। রঙিন ছাপঅলা রাইটিং প্যাড পড়ে আছে টেবিলে—হৃৎপিণ্ডে তীর ছুঁড়ছে কিউপিড। ড্রয়ার থেকে নেভি ব্লু গ্লিটার পেনটা বের করে সে কিউপিডের গায়ে লিখতে বসে। কাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত মনে মনে হাজারবার চিঠির খসড়া করেছে। কিন্তু কিছুতেই যুতসই শব্দগুলো বাগে আসছে না।

গতকাল কোচিং ক্লাস শেষে সে যখন বাড়ি ফিরছিল, পরাগ তার রিকশার পাশে সাইকেল চালাতে চালাতে বলেছিল, ‘মৌ! রিকশাটা একটু ছেড়ে দিবা?’

পরাগকে দেখামাত্র মৌমিতা চমকে উঠেছিল। হৃৎপিণ্ডে কাঁপুনি ধরে গেছিলো। কথাটার আকস্মিকতায় সে তখন এমন স্তব্ধ হয়ে যায় যে, রিকশাঅলাকে ‘মামা, দাঁড়ান—এটুকু বলতেই অযথা সময় নিয়ে নেয়।

রিকশাঅলা তাকে নামিয়ে প্যাডেল মারতে শুরু করলে পরাগ পকেট থেকে পাপড়িখসা দোমড়ানো একটা গোলাপ ওর সামনে ধরে, ‘এটা রাখো!’ তারপর আর এক মুহূর্তও খরচ না করে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে হাওয়া।

সেই সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্যবার সে ঘটনাকে টেনে টেনে দেখেছে, একেকটা মুহূর্তকে প্রত্যেকটা রোমকূপে অনুভব করেছে। ঘোর তাকে ছাড়ছে না। রাতে ঘুম হয়নি এক ফোঁটা।

পরাগকে তার ভাল লাগে। সে কথা একবার মুখ ফসকে কোচিংয়ের সহপাঠী রুনুকে বলেছিল। মেয়েদের মধ্যে চাউর হতে সময় লাগেনি। পরাগ ওদের সামনে দিয়ে গেলেই সবাই একযোগে চিৎকার দিতো, ‘মৌ! এই মৌ!’

ব্যাপারটা বুঝতে ছেলেদেরও দেরি হয়নি। ‘মৌ! এই মৌ!’ শুনলেই সবাই জোরে জোরে হাসতো। পরাগও বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখতো।

মৌমিতার মনের খবর জানাজানি হয়ে গেলেও পরাগ শুধু মুখ টিপে হেসেই গেছে। এতদিনে ওর সময় হলো? কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললো না কেন? প্রেম করতে না চাইলে ফুল দেবে কেন? আর ফুলই যদি দেবে তবে আই লাভ ইউ বলবে না কেন? ফুল যখন দিলিই, ছুটি ফুরানোর মাত্র দুইদিন আগে কেন? সামনের তিন মাস কীভাবে কাটবে মৌমিতার? বোর্ডিংয়ের সেন্সরবোর্ড পার হয়ে পরাগের বেনামী চিঠি পৌঁছাবে তো হাতে?

মৌমিতা যা যা লিখবে ভেবেছিল, তার কিছুই লিখতে পারে না।

এইটুকু লেখে মাত্র—

পরাগ,

খুব মিস করবো তোমাকে। আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখবা তো?

সরাসরি লিখতে সংকোচ হয় বলে শেষে সেই বহুল প্রচলিত সাংকেতিক ভাষার আড়াল নেয়—143 !

চিঠির পেছনে বাসার টিঅ্যান্ডটি নাম্বারটা লিখতে গিয়েও আর লেখে না। ওটা পরাগ চাইলেই জোগাড় করতে পারবে। প্রেম করবা আর একটু খাটবা না?

একরত্তি চিঠিটা লিখতেই আড়াইটা বেজে যায়। সাড়ে তিনটায় কোচিং। মৌমিতা আর দুপুরের খাবার খায় না। বুক ধড়ফড় করছে। পেটের ভেতরে তোলপাড়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয় ওর। পুরনো দাগ মিলাতে না মিলাতেই বাম গালে নতুন একটা ব্রণ—হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কাল রাতে না ঘুমিয়ে চোখের তলায় কালি ফেলেছে। সকালে আলু কোড়া লাগিয়েও লাভ হয়নি। পাউডার দিয়ে সেই কালো অর্ধবৃত্ত ঢাকতে গেলে তা কেমন বিশ্রী ছাইবর্ণ ধারণ করে। যত্ন করে কাজল এঁকেও চোখের ক্লান্তি লুকানো যায় না। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপগ্লস লাগিয়ে চোখের পাতায় আর গালেও একটু ঘষে নেয়। আইশ্যাডো-ব্লাশন কিছুই যখন নেই, কী আর করার! চুলে, কব্জিতে, বাহুমূলে পারফিউম লাগায় যথেচ্ছ। তা-ও মন ভরে না। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলে পরাগের পাশে তাকে যেন কিছুতেই মানাচ্ছে না!

ছয়.

মৌমিতা বেরিয়ে যাওয়ার পর মতিউরের অস্থিরতা চড়তে থাকে। আর কয় ঘণ্টা বাদে মেয়েটা চলে যাবে। তার ইচ্ছা করছিল ডেকে বলে, ‘মা, আজকে কোচিংয়ে না গেলে হয় না? আমার সামনে বসে থাক।’ কিন্তু মেয়েটা যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে ছিলো যে মনে হচ্ছিলো ওকে আটকানোর জোর নাই তার।  

মৌ ছোটবেলায় বাপের বড়ো ন্যাওটা ছিলো। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো– কাকে বেশি ভালবাসো? আব্বু না আম্মুকে? ‘আব্বুকে’ বলতে ওর এক মুহূর্তও লাগতো না।

ও ঝরনার পেটে থাকতে মতিউর অফিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিল যখন, নীলক্ষেত চষে কিনে এনেছিল মস্কোর প্রগতি প্রকাশন থেকে বেরোনো ‘ছেলেমেয়ে মানুষ করা প্রসঙ্গে : মা-বাবার বই’ এর একটা পুরনো কপি। কেমন করে একটা অপরিণত ছোট্ট শিশুকে পূর্ণবিকশিত মানুষ বানিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে মতিউরের কৌতূহলের শেষ ছিলো না। বইটা দিনরাত পড়ে পড়ে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের যাবতীয় পরামর্শ আত্মস্থ করেছিল সে এমন নিষ্ঠায়, যেন সন্তানের জন্ম নয়, সামনে এই বইয়ের ওপর কঠিন পরীক্ষা। ঝরনা তখন ঠোঁট উল্টিয়ে বলতো, ‘ছেলেমেয়ে কেমনে মানুষ করবা, তাও বই পড়ে শেখা লাগে গো?!’

সদ্যোজাত মৌকে প্রথমবার কোলে নিয়ে মতিউরের ভীষণ রোমাঞ্চ হচ্ছিলো। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো কন্যার দিকে। এক লহমায় কত কিছু ভেবেছিল, ভবিষ্যতের কত দৃশ্য দেখে ফেলেছিল! সন্তান মানুষ করা কি সোজা কথা! বড়ো সাধ্য-সাধনার ব্যাপার। জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায়? মেয়ের বয়স দুই ছুঁতে না ছুঁতেই ছবিঅলা বাচ্চাদের বই, যেখানে যা মেলে বাসায় জড়ো করেছিল। মৌ যে তার চেহারা পেয়েছে, তাতে তো তার কোন হাত ছিলো না। কিন্তু নিজের পড়ুয়া স্বভাবটা সে নিজ হাতে মেয়েকে দেবে। 

ঝরনা এসবের ধার ধারতো না। এত ভাবাভাবির কী আছে? বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করতে হলে ভালো স্কুলে দিতে হবে, কোচিং সেন্টারে পাঠাতে হবে। বেয়াড়াপনা দেখলে চড়-চটকানা দিতে হবে, পিঠে কয়েকটা কাঠের স্কেল ভাঙতে হবে। তবেই না মানুষ হবে! মতিউর ছিলো উদ্ধারকর্তা, মায়ের হাত থেকে কেঁদে লাল হওয়া মেয়েকে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতো। আর রাতের বেলা যখন ঘুমে ঝরনার চোখ জড়িয়ে আসছে, তাকে ঠেলতে ঠেলতে বলতো, ‘এই ঝরনা, ঘুমায় গেছো নাকি? শোনো, বাচ্চাদের মারতে হয় না। বুঝায় বলবা, বুঝলা? আর হাত তুলবা না…’ ঝরনা অবশ্য স্বামীর কথা তেমন কানে তুলতো না। ঘুমের ঘোরে ‘হুঁ- হাঁ’ করতে করতেই তার নাক ডাকা শুরু হয়ে যেতো।  

মতিউরের মনে পড়ে, একবার নানাবাড়ি থেকে ফিরে তাকে ধরে মেয়ের সে কি কান্না! সেবার ঝরনার গ্রাম সম্পর্কের ভাই বাদল পাঁচ বছরের মৌকে খেপানোর জন্য বলেছিল,

‘তুমি তো বাপের গায়ের রং পাইছো। তোমার বাপ তো দেখতে ভালো না, কালা!’

‘এহ্! আমার আব্বু সুন্দর!’

‘কী আমার সুন্দর রে! বাইট্টা! থ্যালথ্যাল করে গায়ের গোশত! একটা ঘুষি দিলে ঐ পুকুরে গিয়া পড়বো!’

মৌ রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার আব্বু ঢিশুম ঢিশুম করে তোমার হাড্ডি ভেঙে দিবে!’

বাদল তখন বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো শয়তানি হাসি হেসে কুংফুর প্যাঁচ কষে বলেছিল, ‘ওই বাঁশঝাড় থাইকা একটা মোটা বাঁশ নিয়া শহরে যাইতেছি, দাঁড়াও! তোমার বাপের মাথাটা ফাটায় আসি!’

এ কথা শুনে মৌ দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলেছিল তাকে তক্ষনি শহরে নিয়ে যেতে হবে, নয়ত বাদল মামা আব্বুকে একলা পেয়ে মেরে ফেলবে!

সেই ভয় দীর্ঘদিন পুষে রেখেছিল মৌ। কয়েক বছর পর ভাইদের হাতে জমিজমা সংক্রান্ত মারামারিতে মারা পড়েছিল বাদল। ঝরনা যখন সেই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আফসোস করছিল, মৌমিতা গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘আমার আব্বুকে মারতে চাইছিল তো! উচিত শাস্তি পাইছে! আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিছলাম!’

মতিউরের চোখ ছলছল করে। তার মেয়েটার এখন কত কাজ!

সাত.

কোচিং থেকে ফিরে গোছগাছে লেগে পড়েছে মৌমিতা। হাত-পা চলছে যন্ত্রের মতো। এলোমেলোভাবে জিনিসপত্র ব্যাগে ছুঁড়ছে। খাতা-বই-ইউনিফর্ম-তোয়ালে-কলম-পেন্সিল-লোশন যে যেখানে পারে জায়গা করে নিচ্ছে। ঘরে ঢুকে মেয়ের কাণ্ড দেখে ঝরনা বলে, ‘এইরকম উলটাপালটা কুঁচকামুচকা করে ঢোকাচ্ছ কেন? ব্যাগে আঁটবে না তো! কাপড়চোপড় আঁটসাঁটভাবে ভাঁজ করে ঢোকাও।’

মৌমিতা গুছিয়ে কাজ করবে কীভাবে? তার মাথার ভেতরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। ঠোকরাঠুকরি চলছে। চিন্তারা খোঁড়াতে খোঁড়াতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে। আবার শুরু থেকে শুরু করতে হচ্ছে।  

আজ কোচিং ক্লাসের বান্ধবীরা অবাক হয়েছিল ওর এত সাজগোজ দেখে। পরাগের প্রতি ওর ভালোলাগার কথা যখন সবাই জানেই, তখন পরাগেরটা গোপন রাখার কী আছে? ক্লাস শুরুর আগে সে চোখ-নাক-ঠোঁট তিরতির করে কাঁপিয়ে রুনুকে দিয়েছিল গোলাপ-সংবাদ। মেয়েটার যে পেট পাতলা তা বুঝতে বাকি নেই। মৌমিতার ভালোবাসা যে একতরফা না, তা জনে জনে প্রচার হয়ে যাক তবে! দুটা ক্লাস ছিলো। ফিজিক্স আর ম্যাথ। আজ ক্লাসে মন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আড়চোখে সে দেখছিল পরাগকে। আর বান্ধবীরা সমানে খাতার পাতা ছিঁড়ে ‘কংগ্রাটস’ পাঠাচ্ছিলো তাকে।

ক্লাসের পর রুনুকে দিয়ে পরাগকে ডেকে নিয়ে কোচিংয়ের দালান আর শ্যাওলাধরা পাঁচিলের মাঝখানের চিপা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ওর হাতে চিরকুট গুঁজে দিয়েছিল মৌমিতা। আশা করেছিল পরাগও কিছু দেবে। চিঠি না হলে ফুল, অন্তত গতকালের পাওনা ‘আই লাভ ইউ’। কিন্তু পরাগ চোখমুখ কেমন কাঁচুমাচু করে ‘থ্যাংকস! তোমাকে সুন্দর লাগছে!’ বলে পালিয়ে গেলো।

পরাগের তারিফ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর মন ভালো করে দিলেও আফসোসে মরে যাচ্ছিলো। এভাবে হুট করে চলে গেলো কেন! ওরা দুজন কি কোন ফাস্টফুডে বসতে পারতো না? পরাগ ওর ল্যান্ডফোন নাম্বারটাও তো দিলো না!

এইসব অনুভূতিতে বিহ্বল মৌমিতা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সহপাঠীদের মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছিল না। ক্লাসের স্বর্ণা নামের মেয়েটা হঠাৎ উদয় হয়।  

‘একটা কথা… মৌ…পরাগ তোমাকে ফুল দিছে শুনলাম। আজকে কোচিং শুরুর আগে ছেলেরা ছাতিম গাছটার তলায় জটলা পাকায় গল্প করতেছিল। তখন কানে আসল যে সবাই মিলে পরাগকে নাকি ট্রিট দেবে। ট্রুথ অর ডেয়ার গেমে ও কালকে একটা বিরাট দুঃসাহসী কাজ করছে। আমি জানি না, ওরা কি নিয়ে কথা বলতেছিল। তবে সপ্তাহ খানেক আগেও আমি কিন্তু পরাগকে একটা মেয়ের সাথে ফাস্টফুডে বসতে দেখছি। হাত ধরাধরি অবস্থায়।’

মৌমিতার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। কোনোমতে একটা রিকশা নেয় সে। ঝরে পড়ার আগে নেতানো ফুলের মতো কাঁত হয়ে থাকে। কিন্তু এত ক্লান্তিশ্রান্তি সত্ত্বেও আজ রাতে যে তার ঘুম হবে না, তা জানা। 

বাড়ি ফেরার পর ফোন বেজে উঠলে ওর বুক ধুঁকপুক করতে থাকে। পরাগ নাকি? ঝরনা রিসিভার তোলার আগেই ও দৌড়ে যায় বাবা-মার ঘরে। কাঁপা গলায় হ্যালো বললে যিনি সাড়া দেন, তিনি বাবার সহকর্মী। ঠান্ডা গলায় বাবার খোঁজখবর জানিয়ে নিজের ঘরলাগোয়া বাথরুমে ঢুকে পড়ে মৌমিতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদে। শেষপর্যন্ত ওরা তাকে খেলার ঘুঁটি বানালো? তামাশার জিনিস? কান্নায় ভেতরটা একটু শান্ত হলে কেউ মিনমিনিয়ে সান্ত্বনা দেয়—কোথাও ভুলও তো হতে পারে। স্বর্ণার কথাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে হবে কেন? পরাগের বাসার নাম্বার জোগাড় করে ওকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু ও ঘরে তো আব্বু শুয়ে আছে।  

মৌমিতা চোখমুখ ধুয়ে মতিউরের কাছে যায়। হাসিমুখ করে বলে,

‘আব্বু আজকে যে গরম পড়ছে, এই ঘরটা তো গুমোট হয়ে আছে! চলো, আমার বিছানায় শুয়ে থাকো। আরাম পাবা।’

মতিউরের এতক্ষণ দমবন্ধ লাগছিল। মেয়ের কথায় এক ঝলক ফুরফুরে হাওয়া ঢুকে পড়ে। হায়, এতক্ষণে বাপের দিকে নজর পড়লো মেয়ের! মৌমিতার কাঁধে ভর দিয়ে মতিউর ও ঘরটায় যায়। জানালা দিয়ে ঝিরঝিরে বাতাস ঢুকছে। তার ইচ্ছা করে মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় বসতে, আগের মতো।

কিন্তু মেয়ে তাকে শুইয়ে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যায়।

মৌমিতা তখন বাপ-মায়ের ফাঁকা ঘরে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ক্লাসের একটা ছেলের কাছ থেকে পরাগের টিঅ্যান্ডটি নাম্বার জোগাড় করেছে। সেই নাম্বারে কল দিলে ফোন ধরে পরাগের বড়ো বোন। মৌমিতা তখন মরিয়া। পরাগকে চাই-ই। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে, ‘আপু, পরাগকে একটু দিন। কোচিংয়ের ব্যাপারে ওর সাথে আর্জেন্ট কথা বলা দরকার।’

পরাগ হ্যালো বললে সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ‘ওয়াজ দ্যাট জাস্ট আ গেম?’

পরাগ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,

‘না…আমি পরে ফোন করতেছি তোমাকে।’

পরাগের মুখে ‘না’ শুনে ওর মনটা অল্প শান্ত হয়, কিন্তু শান্তি পায় না। আমতা আমতা করলো কেন? এত ব্যস্ততা কীসের?

নিজের ঘরে ফিরে সে আবার গোছগাছে লেগে পড়ে। ব্যাগ উপুড় করে সব ফেলে দিয়ে আবার একটা একটা করে গোছাতে থাকে। মতিউর একদৃষ্টিকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

‘মৌ, এদিকে আসো!’ গলাটা থরথর করে তার।

বাবার কণ্ঠস্বরে কাঁপুনি টের পেয়ে অবাক হয় মৌমিতা। কাছে গিয়ে বলে,

‘কী হইছে আব্বু?’

‘অসুস্থ বাপের পাশে বসার জন্য তোমার কি একটুও সময় হবে না মা?’ মতিউরের কান্নাচাপা কণ্ঠ কিচ্ছু গোপন করতে পারে না।

বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে মৌমিতার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে ওর। বিছানায় বসে বাবার হাতটা টেনে নেয়।

বহুক্ষণ বাপ-মেয়ে ওভাবেই থাকে। কেউ কিছু বলতে পারে না।

ঝরনা ঘরে ঢুকে দেখে মতিউরের শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। মৌমিতার নাক-চোখ ফুলে গেছে।

আট.

শোয়ার আগে ঘুমের ওষুধ খায়নি মতিউর। আজ রাতে মাথা পরিষ্কার থাকুক। কাল সকালেই তো মৌ চলে যাবে। আবার অন্ধ কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়ার আগে, সব অনুভূতি অবশ হওয়ার আগে যতক্ষণ পারে পিতৃত্ব যাপন করে নিক। পাশে ঝরনা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। খুব পরিশ্রম হচ্ছে ওর ইদানীং।

একটা অবুঝ নাছোড় ইচ্ছা তাকে কামড়ে ধরে থাকে; ঝরনাকে ডেকে তুলে বলতে চায়, ‘মৌকে পাঠাইও না। ও এখানে থাকুক।’ কিন্তু এই কথাটা সে কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারবে না। বাপ হয়ে মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করতে পারে? তার চেয়ে ও দূরে থাকুক। এই অসুখের ছোঁয়াচ থেকে দূরে। কিন্তু সে যতই মেয়েকে রোগশোক থেকে দূরে রাখতে চাক, যে রোগ বংশানুক্রমে তার দেহে ছড়িয়ে গেছে, সেই রোগের বীজ মৌও হয়তো বয়ে বেড়াচ্ছে। জীবনে এই প্রথম মতিউর হায় হায় করে মেয়ের শরীরে তার জিনের দখল বেশি বলে। মেয়ে একদিন বাপ-দাদাকে দোষারোপ করবে না তো? মৌয়ের মুখের আদল, স্বভাবের গড়ন তার মতো বলে একসময় কি আনন্দ হত! দাদার মুখে শুনেছিল—পিতৃমুখী কন্যা বড়ো ভাগ্যবতী হয়! মতিউরের এক শ্যালিকা, যার লাগামছাড়া বেফাঁস কথা বলার স্বভাব, একবার বলেছিল, ‘মৌ তো বাপের লিঙ্গ ছাড়া আর সবই পাইছে!’ কথটা শুনে ঘরের সবাই জিভ কেটে দম ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়েছিল। শুধু মতিউর, রুচিবোধে বাধে বলে, এই চড়া ঠাট্টায় নাক কুঁচকেছিল।

তার এখন খুব সাধ হয় ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখে আসতে। যেমন করে মশারি তুলে সে অবাক চোখে চেয়ে থাকতো এ্যাত্তটুকু মৌয়ের দিকে। ওর গোলগাল মুখের দিকে। কিংবা সেই পাঁচ বছরের অভিমানী মৌ, যে গাল ফুলিয়ে বসে আছে আর মতিউর ছড়া কাটছে—

গালফুলানির মাও
পিঠা ভাইজা দেও
এত পিঠা খাবো না
গালফুলানিক দেও!

বাবার মুখে ছড়া শুনে মৌয়ের থমথমে মুখে হালকা হাসির রেখা ফুটলে মতিউর গাল দুটো টেনে ধরে বলতো, গালফুলানির গাল দুটা তো একদম আমার মায়ের বানানো তেল পিঠার মতো ফুলে আছে!

ও যখন আরও ছোটো, বছর তিন বা চারেকের, ওর অভিমান ভাঙানোর মন্ত্র ছিলো নজরুলের ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’—

এ রাম! তুমি ন্যাংটাপুটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?

লাইন দুটো শুনে লজ্জা পেত মেয়েটা। খিল খিল করে হেসে উঠে বাপের বুকে মুখ লুকাতো।

মতিউরের গভীর থেকে একের পর এক দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। মৌয়ের জীবনের সব বড়ো বড়ো ঘটনাই ঘটার বাকি। এসএসসির রেজাল্টের আগে ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মেয়ের হাত ধরে অভয় দেওয়া…কনভোকেশনে ক্যাপ উড়িয়ে উদযাপনের দিনে গর্বিত বাপের মতো ছবি তোলা…চাকরির প্রথম বেতনে মেয়ের কেনা উপহার খুলে দেখা…লাল শাড়ি পরে বিয়ের মঞ্চ আলো করে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে পুঁচকে মৌয়ের কথা মনে করা…হাসপাতালের বিছানায় সন্তান কোলে মেয়েকে দেখে ওর জন্মমুহূর্ত স্মরণ করে চোখ ঝাপসা করা…এ সবের কোনোটাই ঘটবে না। মতিউরের ভীষণ অস্থির লাগতে থাকে। মাথাটা চারপাশ থেকে টেনে ধরছে, বিজলির মতো ঝলক দিয়ে উঠছে ব্যথা। বুকটা হাপরের মতো উঠছে নামছে। মতিউর আর না পেরে ঝরনাকে ডেকে তোলে। ঘুমিয়ে না পড়তে পারলে হয়তো আজ রাতেই সে মারা পড়বে।

নয়.

মৌমিতা বুঝে গেছে ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে নিস্তার নেই। সমস্ত শক্তি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শরীর অচেতন হবে না।

চোখের পানি গাল বেয়ে কানের লতি চুইয়ে টুপটাপ বালিশে ঝরছে। পরাগ আর কল দেয়নি। ট্রুথ অর ডেয়ার গেমে জিতে যাওয়ায় ছেলেরা হয়তো চাঁদা তুলে ওকে বার্গার, ফ্রেঞ্চফ্রাই, হটডগ, পেস্ট্রি, কোক—সব খাইয়েছে। ও কি তখন তার চিঠিটা বের করে দেখিয়েছে ওদের? সবাই মিলে অনেক হাসাহাসি করেছে? আর কখনো ওই কোচিংয়ে যাওয়ার সাহস হবে না মৌমিতার। কোচিংয়ে কি, হয়তো ওটার পাশ দিয়ে গেলেও সে আঁতকে উঠবে। এই কষ্টই যেন যথেষ্ট ছিলো না। চলে যাওয়ার ঠিক আগের সন্ধ্যায় সে আব্বুকে এভাবে কাঁদাল! ছুটি শেষে সব মেয়েই সুন্দর হয়ে বোর্ডিংয়ে ফেরে। প্রায় সবার গায়ে হালকা মেদের পরত জমে, গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয়, চোখেমুখে সুস্বাস্থ্য-সুখের ছটা দেখা যায়। এবার সবাই দেখবে মৌমিতা পেত্নীর চেহারা নিয়ে ফিরেছে।

বহুদিন পর আজ আগেকার আব্বু ফিরে এলো। তাকে প্রথমবার বোর্ডিংয়ে রেখে আসার সন্ধ্যায় আব্বুর শুধু মুখ না, সারা শরীরটাই বেদর্নাত হয়ে ছিলো। ছলছল চোখ, মাথাটা এক কাঁধে এলিয়ে রাখা, ঝুলে থাকা হাত, একটু কুঁজো হয়ে ঢিলেঢালাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা—বিমর্ষ দৃশ্য। সেদিনের চেয়েও তীব্র বেদনা আর অসহায়ত্ব নিয়ে আজ কুঁকড়ে ছিলো মানুষটা।

দশ.

ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল মৌমিতার। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের বেশি ঘুমাতে পারেনি। আটটায় বাস বলে সাড়ে ছ’টায় ঝরনা তাকে তুলে দিয়েছে। ওঠার পর ওর চোখ জ্বালা করতে থাকে। পরপর দুইরাত প্রায় নির্ঘুম; বাসে আজ নির্ঘাত বমি হবে।

বেরোনোর আগে বিদায় জানাতে বাবার ঘরে ঢোকে সে। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মতিউর। ঝরনা ঝাঁকায় তাকে,

‘মৌয়ের আব্বু, ওঠো! মৌ চলে যাচ্ছে!’

মতিউর চোখ খুলে এক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। তার মৃত মানুষের মতো পলকহীন দৃষ্টি দেখে এক মুহূর্তের জন্য আঁতকে ওঠে মৌমিতা।

সে মনে মনে আব্বুকে কথা দেয়—পরের ছুটিতে বাড়িতে এসে সারাক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকবো। তুমি চোখ খুললেই দেখবা মেয়ে তোমার মুখের সামনে। তোমার অনেক যত্ন করবো, আব্বু!

বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘আব্বু, তুমি শিগগিরই সুস্থ হবা, ইনশাল্লাহ! তোমার মধ্যে এই বিশ্বাস থাকতে হবে! পরের বার তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই!’

মতিউরের চোখের কোনায় শিশির জমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘সাবধানে যাইও।’

মৌমিতা মাকে বলে, ‘তোমরা ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে আমাকে অন-লিভে বাড়ি আনবা কিন্তু!’

ঝরনার চোখ ভিজে যায়। ডাক্তার যে বলে দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়ে কী করবেন? উনি বাঁচবেন না।’, সে কথা মেয়েটা জানে না।

মতিউর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলকও ফেলতে চায় না। তার মন বলছে মেয়েকে সে আর দেখতে পাবে না। মেয়েটা দূরে গেলো, ভালোই হলো। মায়া যত দ্রুত কাটবে, তত সহজ হবে প্রস্থান।

বিজ্ঞাপন
রিফাত আনজুম পিয়া

রিফাত আনজুম পিয়া

একজন উদীয়মান গল্পকার।

লেখকের অন্যান্য লেখা

বিজ্ঞাপন


সদ্য প্রকাশিত

নেয়পায়াসাম
অনুবাদ

নেয়পায়াসাম

আদনান সহিদ
অক্টোবর ২২, ২০২০
0

[মালায়লাম ভাষার শীর্ষ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯) অন্যতম। তাঁর জন্ম কেরালার দক্ষিণ মালাবারের পুণ্যাউরকুলামের এক রক্ষণশীল পরিবারে। বাবার চাকুরিসূত্রে শৈশবের...

যতীনের লোক-জ্যোতি

যতীনের লোক-জ্যোতি

অক্টোবর ১৮, ২০২০
‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ : একটি উত্তর উপনিবেশীয় বিশ্লেষণ

‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ : একটি উত্তর উপনিবেশীয় বিশ্লেষণ

অক্টোবর ১০, ২০২০
ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা

ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
বিষজন্ম বিষমৃত্যু

বিষজন্ম বিষমৃত্যু

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০
কেঁদেও পাবে না তাকে

কেঁদেও পাবে না তাকে

সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

এ মাসের সর্বাধিক পঠিত

ঢোঁড়াই চরিত মানস : প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য ও অধিকার-সচেতনার গল্প
বইকথা

ঢোঁড়াই চরিত মানস : প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য ও অধিকার-সচেতনার গল্প

সাফি উল্লাহ্
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
0

জীবন অন্বেষী ভারতীয় ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫) রচিত অল্প-পঠিত অথচ বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীতে অনন্য উপন্যাস ‘ঢোঁড়াই চরিত...

শার্ল বোদলেয়ার : আধুনিক কবিতার পিতা

শার্ল বোদলেয়ার : আধুনিক কবিতার পিতা

জুলাই ১, ২০২০
জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা

জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা

জুলাই ২৯, ২০২০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’ : উপেক্ষিত প্রাচ্য পুরাণ এবং একটি বিতর্কিত বিনির্মাণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’ : উপেক্ষিত প্রাচ্য পুরাণ এবং একটি বিতর্কিত বিনির্মাণ

জুলাই ৯, ২০২০
রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোত

রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোত

আগস্ট ২১, ২০২০
বিজ্ঞাপন
লেখা পাঠানোর ঠিকানা ও যোগাযোগ
pratiswik2020@gmail.com
অলংকরণ : মাকসুদুল হাকিম

প্রকাশিত লেখার বক্তব্য সম্পর্কিত দায় সংশ্লিষ্ট লেখকের

Design by OneHost BD ©2020 সর্বস্বত্ব সংরক্ষণকারী প্রাতিস্বিক

কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ

© 2020 সর্বসত্ব সংরক্ষকারী প্রাতিস্বিক.