‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ চিনুয়া আচেবের (১৯৩০-২০১৩) প্রথম উপন্যাস; যা নাইজেরিয়ান (আফ্রিকান) ইগবো সংস্কৃতির ওপর ইউরোপীয় উপনিবেশিকতার প্রভাব তোলে ধরেছে। এর প্রকাশকাল ১৯৫৮ সাল। উপন্যাসটিতে আচেবে ইগবো জাতির সংগ্রামের পাশাপাশি আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্রে উপনিবেশবাদের আগমন এবং বিস্তারের চিত্র তুলে ধরেছেন, যা উত্তর উপনিবেশিকতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই পরিলক্ষিত হয়।বিস্তারিত আলোচনায় যাবার পূ্র্বে আমরা এক নজরে দেখে নিই উপনিবেশবাদ এবং উত্তর উপনিবেশবাদ কী।
অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান উপনিবেশবাদকে সংজ্ঞায়িত করে এভাবে, ‘যে নীতি অনুশীলনের মাধ্যমে অপর একটি দেশের পুরো বা আংশিক রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা যায় এবং অর্থনৈতিকভাবে তাকে শোষণ করা যায়।’
কলিন্স ইংরেজি অভিধান এর মতে, ‘উপনিবেশবাদ বলতে সেই নীতির অনুশীলনকে বুঝায় যার দ্বারা কোনো শক্তিশালী দেশ অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দখল করে এবং সেই দুর্বল দেশগুলোর সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদের শক্তি ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে।’
উত্তর উপনিবেশবাদ সম্পর্কে দ্যা ব্রিটিশ একাডেমি বলে, ‘উত্তর উপনিবেশবাদ মূলত উপনিবেশবাদের অভিজ্ঞতা এবং এর অতীত ও বর্তমান প্রভাবকে ব্যাখ্যা করে।’
মূলত ইংরেজি কলোনি অর্থাৎ বসতি স্থাপন থেকেই কলোনিয়ালিজম তথা উপনিবেশবাদ শব্দের উৎপত্তি। উপনিবেশবাদ বলতে বুঝায় শক্তিশালী কোনো দেশের দূরবর্তী কোনো অঞ্চলে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে উক্ত স্থানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করা। আর উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ হলো, এই বিষয়গুলো জেনে, এর অতীত ও বর্তমান প্রভাব পরিলক্ষণের মাধ্যমে এর থেকে বেরিয়ে আসার মতবাদ।
উপন্যাসটির বিষয়বস্তু পুরোপুরি বুঝার জন্য এর ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট জানা জরুরি, যা এই প্রকাশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন নাইজেরিয়া ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ কলোনিতে রূপান্তরিত হয়, তখন দেশটি ব্রিটিশ রাজনৈতিক কাঠামোতে উন্মুক্ত হয়। আচেবে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন, যা মূলত ব্রিটিশদের নাইজেরিয়া দখলের প্রায় ২৫ বছর পর। উক্ত পরিস্থিতিতে আচেবে ব্রিটিশ সংস্কৃতি এবং নাইজেরিয়ান সংস্কৃতির সাথে যুগপৎভাবে পরিচিত হন। এর ফলেই ১৯৫৮ সালে ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এর সৃষ্টি। ২৭ অক্টোবর, ১৯৫৮-তে ব্রিটিশরা সম্মতি দেয় যে নাইজেরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে ১৯৬০ সালের ১লা অক্টোবর। তাই নাইজেরিয়ার স্বাধীনতা দিবস ১লা অক্টোবর, ১৯৬০।
নাইজেরিয়া ২৫০ টির বেশি জাতিগোষ্ঠী এবং ৫০০ এর বেশি ভাষা নিয়ে গঠিত একটি জাতি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এখানে ইগবো, ইয়োরুবা, হাউসা, ইজাও, ফুলানি, কানুরি, ইবিবিও সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তিনটি প্রধান ও অন্যতম হলো :
নাইজেরিয়া
/ | \
ইগবো ইয়োরুবা হাউসা
এই উপন্যাসটি ইগবো সমাজের সংস্কৃতির চিত্র অঙ্কন করে এবং আফ্রিকান দৃষ্টিকোণ থেকে ইগবো সমাজের ওপর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের প্রভাব আলোচনা করে।
W. B. Yeats (উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্)-এর কবিতা ‘The Second Coming’ (দ্যা সেকেন্ড কামিং) থেকে এর শিরোনাম নেওয়া হয়েছে। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা কবিতাটি থেকে উদ্ধৃতি পাই :
বিস্তীর্ণ চক্রে ঘুরে বার বার
বাজপাখি তার পালকের কথা শোনে না আর;
ভেঙে পড়ে সবই; কেন্দ্রীভূত থাকে না কিছুই;
কেবল অরাজকতা পৃথিবীকে করেছে দখল।
[Turning and turning in the widening gyre
The falcon cannot hear the falconer;
Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,]
কবিতা থেকে উদ্ধৃত লাইনগুলো মূলত ঘূর্ণায়মানতা ও পরিবর্তনশীলতা নির্দেশ করে এবং পৃথিবী যে আর আগের মতো হবে না তারও নির্দেশনা বহন করে। ভাঙন, পতন, বিশৃঙ্খলা, রীতিনীতির শিথিলীকরণ, সহিংসতা এই উপন্যাসে উঠে আসে।
বলা হয়ে থাকে যে, ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ এর মূল বিষয় হলো সম্পূর্ণরূপে, ‘পতন, বিভিন্ন অংশে বিভক্তিকরণ, বিশৃঙ্খলা এবং বিভ্রান্তি’, যা ঐতিহ্যবাহী ইগবো সমাজ মিশনারিদের আগমনে সহ্য করে।
‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এর প্রধান চরিত্র ওকোনকো-কে ঘিরে সৃষ্ট, যিনি একাধারে একজন ধনাঢ্যবান সম্মাননীয় যোদ্ধা, একজন গোত্রসদস্য, একজন কৃষক, একজন পরিবার প্রধান এবং উমোফিয়ার একজন প্রভাবশালী নেতা। একদা গ্রামের একজন বয়স্ক সম্মানিত ব্যক্তির মৃত্যুতে ইগবো রীতি অনুযায়ী বৃহৎ ও দীর্ঘ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে লোকজন ড্রাম বাজিয়ে এবং গুলি বর্ষণ করে তাদের প্রথা পালন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওকোনকোর গুলি বর্ষণে তার গোত্রীয় একজন মারা যায়। যেহেতু নিজ গোত্রভুক্ত কাউকে হত্যা ইগবো সমাজে পাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই ওকোনকো-কে সাত বছরের জন্য গ্রামের বাইরে নির্বাসনে পাঠানো হয় তার পাপমুক্তির জন্য। ওকোনকো তার মায়ের গ্রাম মাবানটা-তে গমন করে এবং আশ্রয় গ্রহণ করে। নির্বাসনের দ্বিতীয় বর্ষে তার বন্ধু অবেরিকা তাকে একটি দুঃসংবাদ দেয় যে অ্যাবেম নামক গ্রামটিতে একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি আসে। ওরাকলের কাছে গ্রামবাসী জানতে পারে যে সেই আগন্তুক তাদের গোত্র এবং অন্যান্য গোত্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই গ্রামবাসীরা সেই শ্বেতাঙ্গ আগন্তুক কে হত্যা করে। কয়েক সপ্তাহ পর শ্বেতাঙ্গদের একটি বৃহৎ দল গ্রামবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে যার ফলে পুরো গ্রামখানা শূন্যপ্রায় হয়ে যায়। একই সাথে তারা উমোফিয়া ও দখল করে নেয়। ওকোনকো যখন নির্বাসন শেষে নিজ গ্রাম উমোফিয়াতে ফিরে, তারই মধ্যে খ্রিস্টধর্ম পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যায়। পুরো গোত্র এই নতুন ধর্ম এবং সভ্যতার প্রচলনে বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হয়। এই খ্রিস্টধর্ম ও সভ্যতার প্রচলনে প্রধান ছিলেন জনাব ব্রাউন। ওকোনকো লক্ষ্য করে যে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রথা, আচার-ব্যবহার ও ঐতিহ্যকে অসভ্য ও বর্বর বলে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তন প্রচলিত সংস্কৃতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অপরদিকে জনাব ব্রাউন গ্রামবাসীদের কীভাবে লিখতে ও পড়তে হয় তা শেখানো শুরু করে, আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রচলন করে। গ্রামবাসী এক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যে নতুন এই সংস্কৃতি গ্রহণ করবে নাকি প্রাচীন রীতিনীতি আকড়ে ধরে থাকবে। এরই মধ্যে বহু গ্রামবাসী ধর্মান্তরিত হতে থাকে যাদের মাঝে ওকোনকোর ছেলে নোয়ি-ও রয়েছে। নোয়ি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসাক নামে নতুন পরিচয় গ্রহণ করে। জনাব ব্রাউন অসুস্থতার জন্য যখন তার নিজ দেশে ফিরে যান তখন জনাব স্মিথ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু জনাব স্মিথ ইগবো গোত্রীয় প্রথার সম্পূর্ণ বিরোধী এবং মিশনারি নিয়ম কানুন পালনে অনেক কঠোর। স্মিথ সম্পর্কে উপন্যাসে বলা হয়ে থাকে যে,
‘তিনি সবকিছুকে সাদা ও কালোর ভিত্তিতে পরিমাপ করতেন। এবং কালো মানেই অশুভ। তিনি পৃথিবীকে একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন যেখানে আলোকিত সন্তানেরা সর্বদাই অন্ধকারে অবস্থিতদের সাথে নৈতিক সংঘাতে লিপ্ত’। [He saw things as black and white. And black was evil. He saw the world as battlefield in which the children of light were locked in mortal conflicts with the sons of darkness. (Chapter Twenty Two)]
উপন্যাসের শেষভাগে আমরা দেখতে পাই যে, গোত্রীয়দের একটি আলোচনায় ওকোনকো গ্রামবাসীদের সামনে উপনিবেশবাদের খারাপ দিকগুলা তুলে ধরে তা প্রতিহত করা ও স্বীয় সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করেন। সেই আলোচনায় পাঁচজন ব্রিটিশ বার্তাবাহক আসেন জমায়েত ভঙের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ ওকোনকো লাফিয়ে এগিয়ে আসে আর প্রধান বার্তাবাহক-কে আঘাত করে হত্যা করে। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে লক্ষ্য করে যে তার গোত্রভুক্ত আর কেউই তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না বা বাকি বার্তাবাহকদের পালানোর সময় ফিরানোর চেষ্টাও করছে না। ওকোনকোর জন্য সেই মুহূর্তে সব ভেঙে পড়লো ঠিক যেমনটা করে ইগবো সমাজের পতন হয়েছিল ইউরোপীয় উপনিবেশিকতার আগমনে। সে আত্মহত্যা করলো। জেলা কমিশনার তার মৃত্যুতে ঘটনাস্থলে আসেন এবং তিনি আফ্রিকা সম্পর্কে তার যে বই লিখছিলেন তার শিরোনাম ও ভেবে নেন, ‘নাইজেরিয়ান নিম্নতর আদিম জাতিগোষ্ঠীর শান্তিস্থাপন’[The Pacification of the Primitive Tribes of the Lower Niger.’ (Chapter Twenty Five)]
এভাবে ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাসটিতে আচেবে ইগবো সমাজের ইতিহাস বর্ণনা করে এবং তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিপূর্ণতা ও ত্রুটি তুলে ধরার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে তাদের ভিন্নতা প্রকাশ করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইগবো জনগণের অনন্য সংস্কৃতি গড়ে উঠে তাদের বিভিন্ন রীতিনীতির ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বংশানুক্রমিক দেব-দেবীদের শক্তির ওপর বিশ্বাস করা, ওরাকল-এর নির্দেশনা পালনের জন্য মানববলি দেওয়া, জোড়া সন্তানকে শয়তানের নিদর্শন স্বরূপ হত্যা করা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় দীর্ঘ অনুষ্ঠান পালন, শান্তি সপ্তাহ পালন, বহুবিবাহ রীতি ইত্যাদি।
যদিও মিশনারিদের আগমন ও তাদের উপনিবেশবাদের উদ্দেশ্য ইগবো সমাজের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে, এর কিছু ভালো দিকও রয়েছে। একদিকে ঔপনিবেশিকদের আগমনে ইগবো সমাজের সংস্কৃতি তথা তাদের ভাষা, প্রথা, রীতিনীতি, বিবাহ, ধর্মপালন অর্থাৎ তাদের পুরো জীবনধারণের মাধ্যমই বিপদাপন্ন হয়। অপরদিকে, উপনিবেশবাদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকরা শিক্ষার বিস্তার করে, একবিবাহ প্রথা চালু করে, দেবদেবীদের প্রসন্ন করতে মানবহত্যার রীতি বন্ধ করে যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপনিবেশবাদ শোষণ, ঐতিহ্যের ভাঙন, বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিই তৈরি করে। উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আরো জানতে আমরা বিভিন্ন অনুষঙ্গের উল্লেখ করতে পারি।
ফিলিপাইনে আমেরিকান উপনিবেশবাদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে Rafael (2000) এই একই বিষয়বস্তুর নামকরণ করেন ‘White Love’। এই উক্তির দ্বারা Rafael অসভ্য বর্বর অ-ইউরোপীয়দের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা, তাদের আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তন করে ইংরেজি শেখানো এবং তাদের আদি সংস্কৃতির পরিবর্তন করাকে পশ্চিমাদের দায়িত্ব হিসেবে বর্ণনা করেন। উপনিবেশবাদকে ধর্ম, নৈতিক গুণাবলি এবং সভ্যতার নামে ব্যবহার করা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিকদের সম্পদ তৈরির মাধ্যম।
ঔপনিবেশিকরা অন্যদের অসভ্য, বর্বর ও অভদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করে, যার ফলে তারা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে এর কলোনিভুক্ত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। উপনিবেশিকতাবাদের উদ্দেশ্য পাশ্চাত্যের নৈতিক গুণাবলির ওপর নিহিত নয়, বরং এর লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক। এসব লুকায়িত লক্ষ্যবস্তু প্রকাশ করার মাধ্যমে Spring, Charles Grant-এর উক্তি উল্লেখ করেন :
বিজয়ীদের ভাষা উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের সাথে সহজেই পরাস্তদের একত্রিত করা যায়… এটি হলো বিজয়ের সর্বোৎকৃষ্ট প্রকারভেদ, এবং আমরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে প্রকাশ করতে পারি যে, যেখানে আমাদের রাজনীতি ও ভাষা প্রবর্তিত হবে, আমাদের বাণিজ্য ও তা অনুসরণ করবে। [to introduce the language of the conquerors, seems to be an obvious means of assimilating a conquered people to them… this is the noblest species of conquest, and wherever, we may venture to say, our principles and languages are introduced, our commerce will follow.]
উপনিবেশবাদের সময়ের সকল দলিল নির্দেশ করে যে, উপনিবেশিকতার ইতিহাসে ধর্ম, ভাষা ও অর্থনীতি একই সূত্রে গ্রথিত ছিলো। আচেবের ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ লেখার পূর্বে আফ্রিকা ও আফ্রিকানদের ওপর লেখা প্রায় প্রতিটি উপন্যাসই ইউরোপীয়দের সৃষ্ট ছিলো। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই, ইউরোপীয়দের লেখায় আফ্রিকানদের অসভ্য ও অশিক্ষিত বলে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপীয়রা নিজেদের আফ্রিকানদের থেকে বেশি উন্নত হিসেবে আখ্যায়িত করে। যার ফলে তারা আফ্রিকানদের পুরনো জগত থেকে বের করে আধুনিক সভ্যতা ও শিক্ষা প্রদানে দৃঢ় সংকল্প হয়।
Joseph Conrad-এর Heart of Darkness বহুল পঠিত উপন্যাস যা ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত এবং যা আফ্রিকাকে বর্ণনা করে ‘wild and dark’ অর্থাৎ ‘বন্য ও অন্ধকারাচ্ছন্ন’হিসেবে। আফ্রিকা এবং এর জনগণের যে বর্ণনা Joseph Conrad তাঁর উপন্যাস Heart of Darkness-এ এবং Joyce Cary তার Mister Johnson-এ প্রদান করে তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আচেবে এবং অন্যান্য আফ্রিকান লেখকরা তাদের লেখার মাধ্যমে আফ্রিকা ও এর জনগণ সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে উদ্যত হন।
এই উপন্যাসটি যখন আচেবে লিখেন তখন নাইজেরিয়াতে আরো অনেক লেখকের উত্থান হয় যাদের মধ্যে Wole Soyinka এবং Ben Okri অন্যতম। আচেবে ছিলেন একজন সফল লেখক কারণ তিনি আফ্রিকাতে খ্রিস্টধর্মের ভূমিকা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছিলেন এবং তার এই সমালোচনামূলক লেখা পুরো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
উত্তর উপনিবেশিকতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ইউরোপীয়রা তাদের সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বতন বলে মনে করে যা থেকে তাদের এক ধ্যান ধারণার উৎপত্তি হয় যাকে বলা হয়, ‘Eurocentric View’। উক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে ইউরোপকে সভ্যতা ও মানবতার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করা হয়। এটি উপনিবেশিকতার বর্ণবাদী দিক ও প্রকাশ করে যেখানে তারা কৃষ্ণাঙ্গ অ-ইউরোপীয়দের নিম্নতর বলে বিবেচনা করে। আফ্রিকান তথা তার জনগণের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে আচেবে এখানে নাইজেরিয়ান ইগবো সমাজের সকল সাংস্কৃতিক বিচিত্রতা তুলে ধরেন।
উপনিবেশবাদ স্থানীয় ইগবো জনগোষ্ঠী ও ঔপনিবেশিকদের মাঝে একটি সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ তৈরি করে যা উপন্যাসটিতে বারবার ফুটে ওঠে। এটি একটি প্রধান দ্বন্দ্ব যা ‘The Arrow of God’-তেও দেখা যায়। দুটি উপন্যাসে একটি সাদৃশ্য রয়েছে যে উভয় ক্ষেত্রে উমোফিয়া এবং উমোয়ানো গ্রামবাসী ঔপনিবেশিকদের আগমনে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তাই উপন্যাসটির উত্তর উপনিবেশিক আলোচনা আমাদের উপনিবেশবাদের ফলে সৃষ্ট ভাঙন, পতন, শাসন-শোষণের একটি স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ওকোনকোর পাশাপাশি ইগবো সমাজ সংস্কৃতির পতন উপনিবেশবাদের অন্ধকার ও অশুভ দিক প্রকাশ করে। উপনিবেশিক শোষণ যা মূলত- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে হয়ে থাকে তার বৈধতা অর্জনের জন্য তারা ‘The White Man’s Burden’ নামক উক্তিটির প্রচলন করে থাকে। ইংরেজ কবি Rudyard Kipling উপনিবেশবাদ সম্পর্কে বর্ণনার জন্য ‘White Man’s Burden’ উক্তিটি ব্যবহার করেন, যার দ্বারা মূলত বুঝানো হয় যে অসভ্য বর্বর অ-ইউরোপীয়দের আলোকিত শিক্ষিত ও সভ্য করার দায়িত্বের বোঝা ইউরোপীয়দের ওপর ন্যস্ত। উপনিবেশিকতাকে ধর্ম, নৈতিক গুনাবলি ও সভ্যতার নামে প্রচার করা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিকদের সম্পদ তৈরির মাধ্যম। উপন্যাসটিতে মিশনারিরা ইগবো সমাজের ক্ষমতা দখলের জন্য এবং সেই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য শত্রুতাপূর্ণ পথ অবলম্বন করে। একইসাথে ইগবো সমাজের ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও বিশ্বাসকে দূরীভূত করাও তাদের লক্ষ্য ছিলো। এখানে যে সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা যায় তা ইউরোপীয়দের নিজেদের সংস্কৃতিকে উচ্চতর বলে মনে করার ফলেই সৃষ্ট। অপরদিকে ইউরোপীয় ও আফ্রিকানদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে সহনশীল করতে পারতো। কিন্তু এই উপনিবেশবাদে আমরা শুধু বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও ইগবো সমাজের ভাঙনই দেখতে পাই। এভাবেই উত্তর-উপনিবেশিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপনিবেশবাদের সর্বগ্রাসী নীতির ফলে ইগবো সমাজ তথা আফ্রিকার পতন স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।