[মালায়লাম ভাষার শীর্ষ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯) অন্যতম। তাঁর জন্ম কেরালার দক্ষিণ মালাবারের পুণ্যাউরকুলামের এক রক্ষণশীল পরিবারে। বাবার চাকুরিসূত্রে শৈশবের বড়ো একটা অংশ কাটিয়েছেন কলকাতায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর না এগোলেও বাড়িতে বসেই পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি সাহিত্যানুরাগী পরিবারের সংস্পর্শে শৈশবেই লেখা শুরু করেন কবিতা ও গল্প। তাঁর লেখক ছদ্মনাম মাধবীকুট্টি। ১৯৯৯ সালে ৬৫ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হবার পর কমলা সুরাইয়া নাম ধারণ করেন তিনি।
মালায়লাম ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে পারদর্শী কমলা দাস একাধারে লিখেছেন প্রচুর কবিতা, ছোটোগল্প, অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও আত্মজীবনী। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘এন্তে কথা’ (মাই স্টোরি) এখনও পর্যন্ত ভারতে কোনো নারী রচিত সর্বাধিক বিক্রিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। তাঁর কাব্য সংকলনগুলোর মধ্যে ‘সামার ইন ক্যালকাটা’, ‘দ্যা ডিসেন্ডেন্টস, ‘দ্যা ওল্ড প্লে হাউজ’, ‘দ্য লুকিং গ্লাস’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘অ্যান অ্যান্থোলজি অফ কমনওয়েলথ ভার্সেস’, ‘ইয়ং কমনওয়েলথ পোয়েটস (১৯৬৫), দ্য পেঙ্গুইন অ্যান্থোলজি অফ ওম্যান পোয়েটস (১৯৭৩), ওয়ার্ল্ড অ্যান্থোলজি অফ লিভিং পোয়েটস (১৯৭৩) ইত্যাদি কাব্য সংকলনে তাঁর বহু কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষা ছাড়াও স্প্যানিশ, রাশিয়ান, জার্মান, জাপানি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ১৯৭১-১৯৭২ সালে কমলা দাস ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার’ কাব্যবিষয়ক সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মালায়লাম ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র ‘মাথুরাভূমির’ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
কমলা দাসের পুরস্কার ও স্বীকৃতির ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ। মালায়ালাম ভাষায় ‘থানেপ্পু’ ছোটোগল্প রচনার জন্য তিনি ‘কেরালা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’, সাহসী সাংবাদিকতার জন্য ‘চমন লাল পুরস্কার’, এশীয় কবিতায় অবদানে ‘পিইএন পুরস্কার’ এবং ‘নীরামাথালাম পুথা কালাম’ উপন্যাসের জন্য ‘ভায়ালার এ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছেন। ‘এশিয়ান ওয়ার্ল্ড প্রাইজ’, ‘ইজহুথ্থাচ্ছাম পুরস্কারাম’ ‘কেন্ট এ্যাওয়ার্ড’, ‘কেন্দ্র সাহিত্য একাডেমি এ্যাওয়ার্ড’, ‘মুত্তাথু ভার্কি এ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি পুরস্কারও সগৌরবে তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে নোবেল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও মনোনীত হন এই প্রথিতযশা সাহিত্যিক।
নেয়পায়াসাম গল্পটি কমলা দাসের অন্যতম জনপ্রিয় সৃষ্টি। নেয়পায়াসাম মূলত কেরালার পুডিং ধাঁচের ‘ঘি’ মিশ্রিত একধরনের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি মিষ্টান্ন যা বিশেষ উৎসব উপলক্ষ্যে পরিবেশন করা হয়। নেয়পায়াসাম মিষ্টান্নের আশ্রয়ে গল্পকার এখানে মালায়ালাম এক মধ্যবিত্ত পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ নারীর মৃত্যুতে সদস্যদের মাঝে সৃষ্ট মনোদৈহিক সাংসারিক সংকট, অনিশ্চয়তা ও নীরব ভালবাসা প্রদর্শন করেছেন। গল্পটি মালায়লাম ভাষা থেকে ‘সুইট মিল্ক’ শিরোনামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সিধু ভি. নায়ার। মূল শিরোনাম অপরিবর্তিত রেখে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আদনান সহিদ।]
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাতে বাড়ি ফিরছিলো লোকটি। তাকে আমরা ‘আচ্ছান’ নামেই ডাকতে পারি। শহরের বুকে তার তিন সন্তানই কেবল তার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারতো। তারা ‘আচ্ছা’ বলে ডাকতো তাকে।
বাড়ি ফেরার বাসে অপরিচিত লোকজনের ভিড়ে বসে বিশেষ একটি দিন ও সেদিনের প্রতিটা মুহূর্তের কথা ভাবছিলো আচ্ছান।
প্রতিদিন সকালে তার নিয়মমাফিক ঘুম ভাঙতো বিশেষ এক কণ্ঠস্বর শুনে।
‘উন্নিয়ে, এভাবে মুখ ঢেকে ঘুমিও না। আজ সোমবার।‘ বড়ো ছেলেটাকে ঘুম থেকে ডাকতো সেই কণ্ঠস্বর। তারপর যখন রান্নাঘরে ঢুকতো, তার সাদা শাড়িটাতে বড়ো ধরনের ভাঁজ পড়তো কয়েকটা। বিশাল একটা মগে আচ্ছানকে কফি দিতো সে। তারপর কী? তারপর এমন কিছু কি সে করতো যা ভোলার মতো নয়? কিন্তু ভুলে গেছে আচ্ছান? অনেক চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারলো না।
‘এভাবে মুখ ঢেকে ঘুমিও না। আজ সোমবার।‘- এই বাক্যটাই বারবার মাথায় ঘুরছে তার। মনে মনে বাক্যটা প্রার্থনার মতো করে জপতে লাগলো যেন ভুলে গেলেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে!
সকালে কাজে বের হওয়ার সময় বাচ্চাগুলো আচ্ছানের সাথেই বের হতো। তাদের মা ছোটো অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে সবার জন্য টিফিন দিয়ে দিতো। তার ডান হাতে হলুদের স্পষ্ট দাগ লেগে থাকতে দেখা যেতো তখন।
কাজে গিয়ে আচ্ছানের স্ত্রীর কথা তেমন মনে হতো না বললেই চলে। বছর দু-এক আইনি লড়াইয়ের পর বাবা-মার অমতে তাদের দুজনের বিয়ে হয়। এ নিয়ে অবশ্য তাদের কখনও অনুশোচনাও হয়নি। অর্থের অভাব কিংবা বাচ্চাদের অসুস্থতা প্রায়ই হতাশ করে তুলতো তাদের। বাচ্চাদের মা অবশ্য এসব হতাশা পাত্তা দিতো না। তবে আচ্ছানের মুখের হাসি ঠিকই উধাও হয়ে যেতো। যা-ই ঘটুক না কেনো, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা অটুট থাকতো। তিন ছেলেও তাদের বাবা-মাকে বেশ পছন্দ করতো। উন্নির বয়স দশ, বালানের সাত, আর রাজনের পাঁচ বছর। ছেলেগুলোর চেহারায় সবসময় একটা অপরিচ্ছন্ন ভাব বজায় থাকতো, তাদের না ছিলো সৌন্দর্যবোধ না ছিলো মেধা! তারপরেও বাবা-মা সব সময় বলাবলি করতো-
‘উন্নি কত কিছু বানাতে পারে। একদিন সে ইঞ্জিনিয়ারই হবে দেখো।’
‘বালানকে আমরা ডাক্তার বানাবো। ওর কপালটা দেখেছো? কত চওড়া? চওড়া কপালের মানুষ মেধাবী হয়।’
‘রাজন তো অন্ধকার ভয়ই পায় না। খুবই সাহসী। তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দেওয়া উচিত।’
শহরের এক মধ্যবিত্ত পাড়ায় সরু গলিতে ছিলো তাদের বাস। দোতলায় তিন রুমের একটা বাসায় থাকতো ওরা, বারান্দাটায় দুজন মানুষ ঠাসাঠাসি করে কোনোমতে দাঁড়াতে পারতো। তাদের মা একটা টবে পাণিনির গাছ লাগিয়েছিলো, ফুল ফোটেনি এখনও।
রান্নাঘরের দেয়ালে পেতলের চামচ, খুন্তিগুলো ঝোলানো থাকতো। চুলার ধারে পাতা থাকতো একটা কাঠের পিঁড়ি। বাবা কাজ শেষে ফিরলে ছেলেদের মা সেখানে বসে চাপাতি রুটি বানাতো।
বাসটা থামতেই নেমে পড়লো আচ্ছান। নামতে না নামতেই হঠাৎ পায়ে টনটনে ব্যথা অনুভব করলো। আর্থ্রাইটিসের ব্যথা শুরু হলো নাকি আবার? বিছানায় পড়ে গেলে বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে এখন? হঠাৎ তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। ময়লা রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে তাড়াতাড়ি পা চালালো সামনে।
বাচ্চাগুলো কি ঘুমিয়ে পড়লো এতক্ষণে? কিছু খেলো কি? নাকি কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেলো? সত্যিই বাচ্চাগুলো এখনও অনেকটাই অবুঝ। তাদের মাকে সেদিন যখন ট্যাক্সিতে তোলা হচ্ছিলো উন্নি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছিলো। সবচেয়ে ছোটো ছেলেটা কাঁদছিলো কেবল ট্যাক্সিতে চড়ার বায়না করে। মায়ের মৃত্যুর অর্থ আসলেই বুঝে উঠতে পারেনি তারা সেদিন ।
সত্যি বলতে আমিও কি বুঝেছিলাম সেই মৃত্যুর মানে? একবার ভাবলো আচ্ছান। না! কখনও ভাবিইনি এক সন্ধ্যায় সে হুট করে পড়ে যাবে আর চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে! সামান্যটুকু বিদায়ও না নিয়ে!
কাজ থেকে ফিরে আচ্ছান রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। স্ত্রীর কোনো চিহ্ন দেখতে পেলো না সেখানে। কেবল খাঁ খাঁ এক শূন্যতা যেন!
সামনের উঠানে ছেলেদের খেলার শব্দ শুনতে পেলো সে। উন্নির চিৎকার শোনা গেলো ‘চমৎকার শট!’
চাবি গিয়ে সেদিন সদর দরজা খুলেছিলো আচ্ছান। মেঝেতে পড়ে থাকা স্ত্রীর নিথর দেহ আবিষ্কার করে চমকে উঠেছিলো। মুখটা হাঁ করে খোলা! মনে হয়েছিলো হয়তো পিছলে পড়ে গিয়েছে সে। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার বলেছিলো, ‘প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আগেই মারা গেছে রোগী, হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে।’
মৃত স্ত্রীর কথা ভাবতে ভাবতে আবেগ উথলে উঠলো তার। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ রাগ উঠলো স্ত্রীর ওপর- কীভাবে পারলো সে তাকে ছেড়ে যেতে! সব দায়-দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চড়িয়ে এভাবে চলে যায় কেউ!
বাচ্চাগুলোকে গোসল করাবে কে এখন? কে তাদের খাওয়াবে? অসুস্থ হলে সেবাই বা করবে কে?
‘আমার স্ত্রী আর নেই! আজ হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে। আমার দুদিনের ছুটি চাই।’ ফিসফিসিয়ে যেন নিজেকেই শোনালো সে।
অদ্ভুত এক ছুটির দরখাস্ত! স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য ছুটি নিচ্ছে না আচ্ছান। ছুটি নিচ্ছে কারণ তার স্ত্রী মারা গেছে! অফিসের বড়োকর্তা হয়তো তাকে ডাকবেন, দুঃখ প্রকাশ করবেন। কে চেয়েছিলো এমন দুঃখ! স্ত্রীকে অচেনা মনে হতে লাগলো তার। অচেনা মনে হলো তার কোকড়ানো চুলের ডগা। তার ক্লান্ত হাসি, ধীর পায়ে চলা- সব হারিয়ে গেছে যেন নিমিষেই! সবকিছু!
বাসার দরজা খুলে ঢুকতেই সবচেয়ে ছোটো ছেলেটা দৌড়ে এসে বললো তাকে, ‘মা এখনও আসেনি।’
এত তাড়াতাড়ি কীভাবে ভুলে গেলো ছেলেটা সব কিছু! সত্যিই কি সে ভাবছে ট্যাক্সিতে বয়ে নিয়ে যাওয়া সেদিনের মৃতদেহটা ফিরে আসবে আবার? ছেলেটাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলো সে।
‘উন্নি’, বড়ো ছেলেকে ডাকলো।
‘কী? বলো আচ্ছা।’
উন্নি রান্নাঘরে এসে বললো, ‘বালান ঘুমিয়ে পড়েছে।’
‘ঠিক আছে। তোমরা খাওয়া-দাওয়া করেছো কিছু?’
‘না।’ উন্নির উত্তর।
টেবিলের ওপর রাখা খাবারের ঢাকনাগুলো সরালো সে : চাপাতি, ভাত, আলুর তরকারি, চিপস,দই- সব তাদের মা’র রান্না। কাচের একটা বাটিতে বাচ্চাদের জন্য প্রায়ই রান্না করতো সে ‘নেয়পায়াসাম’ নামের মিষ্টান্নটা।
না! এই মিষ্টান্ন বাচ্চাদের খেতে দেওয়া যাবে না। মৃত্যুর ছোঁয়া লেগে গেছে এতে।
‘এগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি তোমাদের জন্য কিছু উপ্পুমাভু বানাচ্ছি।’ বললাম আমি।
‘ঠিক আছে।’ উন্নি বললো।
‘মা কখন আসবে? মা-ই কি তা ভালো বানাতে পারতো না?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ভাবলো, প্রকৃত সত্যটা জানানোর জন্য আরেকটা দিন অপেক্ষা করা যাক। আজ রাতে বাচ্চাদের আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।
‘মা আসবে।’ আচ্ছান উত্তর দিলো।
মেঝেতে দুইটা পরিষ্কার খাবার বাটি পাতলো সে।
‘বালান ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।’
‘আচ্ছান, নেয়পায়াসাম! বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ছোটো ছেলে, রাজন মিষ্টান্ন’র বাটিতে হাত চুবিয়ে দিলো। তার মা যে কাঠের পিঁড়িটাতে বসতো সেটাতেই বসে আছে সে।
‘উন্নি, তুমি কি নেয়পায়াসাটা বেড়ে দেবে? আচ্ছানের শরীর ভালো লাগছে না, মাথাব্যথা করছে।’
থাক বাচ্চারা খাক! সাধ মিটিয়েই খাক। আর কখনও তো মায়ের হাতের রান্না জুটবে না কপালে!
বাচ্চারা মা’র হাতের নেয়পায়াসাম খাওয়া শুরু করলো। নীরব, নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে বাবা তাদের খাওয়া দেখতে লাগলো বসে বসে।
‘উন্নি, তুমি ভাত খাবে না?’
‘না, আমরা শুধু নেয়পায়াসামই খাবো। খুবই মজা হয়েছে এটা!’
‘হ্যাঁ! মা চমৎকার নেয়পায়াসাম রান্না করেছেন।’ কণ্ঠে যেন আনন্দ ঝরে পড়ছে রাজনের।
হঠাৎ ওদের মাঝখান থেকে উঠে দ্রুত হেঁটে বাথরুমের দিকে চলে গেলো আচ্ছান, তাদের বাবা।