Pratiswik
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
Pratiswik
কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
বিজ্ঞাপন
ADVERTISEMENT
হোম অনূর্ধ্ব ২৭
বিষজন্ম বিষমৃত্যু

বিষজন্ম বিষমৃত্যু

সৌর শাইন সৌর শাইন
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০
বিভাগ : অনূর্ধ্ব ২৭, গল্প
104
Views
ফেসবুকটুইটারহুয়ার্ট্সঅ্যাপলিংকইন্ডই-মেইল

পুলিশ এলো রাত পৌনে একটায়। তখন পুরো পাড়া থমথমে, নিস্তব্ধতার আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো। পায়ের শব্দে তছনছ হয়ে যেতে লাগলো রজত আলীর বর্তমান, যা ক্রমেই বাঁধা পড়তে যাচ্ছে অতীতের রশিতে। বাড়ির পাশে বুড়ো গাবগাছটা বয়সে রজত আলীর চেয়ে অনেক বড়ো। লোকেরা বলে থাকে, এই গাছটা রজতের বাপ রহত আলীদের তিনপুরুষের জন্মসাক্ষী। আর এ জন্যই জিনাল বুড়ি পাড়ায় পাড়ায় বলে বেড়ায়, ‘রজতের আকাম-কুকামের হিসাব কোনো আদমের বাচ্চায় না রাখলেও, এই বটগাছটা ঠিকই রাখছে। গাছের যদি জোবান থাকতো, তাইলে কীর্তিডা দেহোন যাইতো। কুত্তার বাচ্চায় একটা জাত হারামি।’

রজত আলী জিনাল বুড়ির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলো অনেক আগে খাসি চুরির অপরাধে। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অভিশাপ বুড়ি দেয়নি। বহুকাল পরে, খোদা বুড়ির ইচ্ছা পূরণ করেছে। আর সে সুখে, নিজের অভিশাপের শক্তি সামর্থ্য গেয়ে বেড়াচ্ছে। ‘দেখলি তো, মুরুব্বির অভিশাপ কেমুন ফলে, বুঝবি তো সময় অইলে।’

পুলিশের গাড়ির হর্নে ছেলে বুড়ো সকলে এসে জড়ো হয়েছে রজত আলীর ভিটেতে। দোচালা ঘরে ঝুলছে রজত আলীর লাশ। দারোগা সবকিছু দেখলো, শুনলো, ছোটো একটা নোটবুকে লিখলো। বড়ো চৌকির পাটাতনে দাঁড়িয়ে লাশের মুখমণ্ডল দেখার চেষ্টা করলো। বিশ্রী দুর্গন্ধে দারোগা আর দাঁড়াতে পারলো না। অবশেষে পাড়ার কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে ডাকিয়ে লাশ নামানো হলো। ময়লা জামা পরা লাশটা ধরতে গিয়েও খানিকটা পিছিয়ে এলো সবাই। মৃত্যুর চেয়ে বাস্তব ভয়ানক যেন লাশের স্পর্শ!

লাশ নামাতেই কিছুটা অসাবধানতাবশত থেঁতনা খেয়ে মাটিতে পড়ে উল্টে গেলো। উপুড় হওয়া লাশ সোজা ও চিৎ করে শোয়াতেই দেখা গেলো মাটি তরলে ভিজে গেছে। হারিকেন হাতে মহিলারা মুখে কাপড় চেপে ধরলো।

কোনো এক বৃদ্ধ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো, হারামজাদায় মদ গিলতে গিলতে ফাঁস লইছে।

মির্জানগরের পথের ধূলি উড়িয়ে রাতেই পুলিশ লাশ নিয়ে থানার পথে রওনা দিলো। পুলিশের গাড়ি চলে যাবার পর একটা নিস্তব্ধতা ছুঁয়ে গেলো চারপাশ ঘিরে। কিছুসময় পরে নীরবতা ভেঙে গ্রামের লোকজনের মুখে মুখে শুরু হলো পোস্টমর্টেমের ভয়াবহতা নিয়ে নানা গুঞ্জন। নানাজন নানা শোনাকথা আত্মীয়-স্বজনদের নাম রেফারেন্সে বলতে লাগলো। কেউ বললো, দাঁত, চোখ, কিডনি সবকিছু হাসপাতালে কেটে রেখে দেওয়া হবে, তারপর জামা সেলাইয়ের মতো করে শরীরটা আবার ঠিক করে দিবে। কেউ আরেকটু দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বললো, রক্তটাও রেখে দিবে, হার্ট-লিভারও রাখতে পারে।

পুরো পাড়া জুড়ে রজত আলীর অপকর্মের ফর্দ সবাই মুখে মুখে বলে বেড়াচ্ছে। সেই কবে কোন বৈশাখী রাতে বেশ্যালয়ের এক নারীকে এনে দিন দশেক বাড়ি রেখেছিলো, ঝোপের আড়ালে সারারাত নেশা করে কার ঘরে ঢুকে বউ-ঝিয়ের ওপর হাত দিয়েছিলো। এছাড়া কোথায় দল বেঁধে ওরা চুরি-ডাকাতি করেছিলো এইসব পুরোনো কাসুন্দি!

নারী-মদ-নেশা এসবেই সবসময় মশগুল থাকতো রজত। জীবনের ফাঁদচক্রে অপরিণত ঢেউ বরাবরই আছড়ে পড়ে। যা একেকজনকে কচুরিপানার মতো ভাসিয়ে নেয় নানা দিকে। রজত এর বাইরে নয়। রজতের কথিত বাপ রহত আলীর সংসার ছিলো তিনটা। দ্বিতীয় স্ত্রী জোহরাই ছিলো রজতের মা, তাকে তালাক দেবার পর রজতের জন্ম। শিশু রজতের যখন ছ’মাস বয়স, তখন ওর মা ওকে রহত আলীর ভিটেতে রেখে যায়। তারপর পাশের বাড়ির নিঃসন্তান মিনারা বেগম ওকে বড়ো করে তোলে। রহত আলী রজতকে নিজের সন্তান বলে মেনে নেয়নি। অভিযোগ তোলে, রজতের প্রকৃত বাবা শিরো মোল্লা। লোকমুখেও প্রচার পায়, শিরো মোল্লার সাথে রহতের বউ প্রায়ই ঘাটের নায়ে দেখা করতে যেতো। পুরো বিষয়টা সবার কাছেই রহস্য উপাদান, সুযোগ পেলেই সেই রহস্যের স্বাদ আস্বাদন করতে থাকে। পরের দুশ্চরিত্র বিষয়ক ইতিহাস বর্ণনায় একেকজনের মুখে খই ফুটে। হাসির কলকলানিতে নিজেদের মাঝে পরকীয়া রস সুখভোগ খুঁজে বেড়ায়। লোকমুখে নানা কথা ভেসে বেড়ায় কান থেকে মুখে, মুখ থেকে কানে। কেউ বলে শিরো মোল্লা জোহরাকে বিয়ে করে দূরের শহরে বিক্রি করে দিয়েছে, আবার কেউ বলে শিরো মোল্লা হজ্ব করা মানুষ, সে এমন কাজ করতে পারে না, খুঁজলেই জানা যাবে জোহরা শহরে রানির হালে আছে।

মিনারা বেগমের মৃত্যুর পর পাঁচ বছরের রজত ঠাঁই নেয় মোড়ের চায়ের দোকানে। ক্ষুধা পেলে কখনো কখনো পিতা রহত আলীর ভিটেতে উঁকি দিতো। তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া সেখানে সে বিশেষ কোনো সমাদর পায়নি। তারপর আত্মবিচরণ, সুঁতোবিহীন ঘুড়ির মতো স্বাধীন অস্তিত্ব প্রকাশ। মাটিতে ঝোপে জঙ্গলে লুটিয়ে পড়া, এখানে-ওখানে লাথি-গুঁতো-তাড়া খাওয়া। রজতের যখন দশ বছর বয়স, তখন থেকে শুরু হয় মাটি কাটার কাজ। সংঘবদ্ধ মাটাল দলের সাথে দেশের নানা জায়গায় সে কাজ করে বেড়ায়। কখনো লোকাল বাসের হেল্পার, কখনো হোটেলের কর্মচারী আবার কখনো কাউন্টার মাস্টারের সহকারী বা কখনো লাইনম্যান হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে জলজ্যান্ত জীবনের বাল্য-কৈশোর। বিদ্যালয়ে পা রাখার সুযোগটুকু কখনো মেলেনি।

পৃথিবীতে দিব্যি ছুটে চলে রজতের জীবন। অন্য বাস হেল্পারদের সঙ্গে মিশে রজত একদিন খোঁজ পায় যৌন জগতের। ক্ষুধা-আহ্লাদ, আপন-পর, অভাব-অনটন এতসব কিছুর বাইরে আরো একটি গোপন জগত আছে। সে জগতের বারান্দায় প্রবেশ করতেই অস্তিত্বের তীব্র অনুভূতি উরুর ফাঁকে জানান দেয়। বাল্য ও কৈশোর কালের সেতু বন্ধনে উঁকি দেয় এই ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি। মাত্র বারো বছর বয়সে সে নারী মাংসের স্বাদ আস্বাদন করে। ঝড়ের বেগে শরীরের নৃত্য ও বীর্যস্খলনের সমাপ্তি ব্যতীত রজত আর কিছু শিখতে পারেনি। পনেরো পেরোতেই শিখে ফেলে কীভাবে নারীর স্তন কামড়ে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করা যায়। শরীরের নানা স্থানে নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত করাও নেশার যোগান দেয়। এইসব আচরণ সে আয়ত্ত করেছে নিজে নিজেই শূন্যতার মহাস্তর থেকে, নির্দয় তপস্যায় পাষণ্ড হবার প্রেষণা থেকে। আর এই তপস্যায় কেউ বাধা দিলে, নির্দ্বিধায় সে জবাব দেয়, ‘টেহা খরচা কইরা লাগাইতে আসছি, ভক্কর-চক্কর করবি তো মাগি, টাইন্যা ছিঁড়া ফালায়াম।’

এভাবেই দিন-কাল পেরিয়ে যাচ্ছে। আর দশটা সামাজিক জীবন ও মন কেন্দ্রিক যে যোগ-বিয়োগের হিসেব কষা বহাল থাকে, সে যন্ত্রণার ধান্ধা রজতের মস্তিষ্কে নেই। নারী মানেই তার কাছে ঝাপটে ধরা সম্ভোগ, এর বাইরে কিছু নয়। তবু তাকে একদিন ধরা দিতে হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরশপাথরময় জীবনের ফাঁদে।

মফস্বল এলাকার রোডের পাশে স’মিলের গাছের গুঁড়ির ওপর ঘুমিয়ে ছিলো রজত। শরীর কাঁপিয়ে আসা জ্বর তাকে ঠেলে দেয় ভয়ানক অবসাদে। সে রাতে লেবার মেসে ফেরা কিংবা কোনো বেশ্যার ঘরে যাবার মত পরিস্থিতি তার ছিলো না। সে পথ দিয়ে রমিজ মুন্সি হোন্ডা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তখন। ঘুমন্ত রজতকে দেখে সন্দেহবশত হোন্ডা থামান। কয়েকবার ডাকার পরও সাড়া মেলেনি। অতঃপর রমিজ মুন্সি নিজেই নেমে এগিয়ে যান। মুখের ওপর থেকে গামছা সরিয়ে দেখতে পান অপরিচিত মুখ। ঘুমন্ত রজতের কপালে হাত দিতেই রমিজ মুন্সি বুঝতে পারেন লোকটা জ্বরে আক্রান্ত। এক অজানা মায়ার উদ্রেক ঘটে তার মনে। গ্যারেজে কল দিয়ে অটোরিক্সা ডাকেন। তারপর ধরাধরি করে রজতকে অটোতে চড়িয়ে রমিজ মুন্সির বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

রাত পেরিয়ে ভোরের আজান এসে পৌঁছে রজতের কানে। ত্বক ইন্দ্রিয় জানান দেয়, কপালের ওপর শীতল স্পর্শ। রোগাক্রান্ত কৌতূহলী চোখ দুটোকে মেলতে চেষ্টা করে অনেক কষ্টে। অচেনা ঘর, অজানা বিছানা, অপরিচিত মুখ ধরা দেয় দৃষ্টি সীমার ভেতর। হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তোলার চেষ্টা করছিলো সে।

না না.. একদম নড়াচড়া করা যাবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো।
মায়াবী নারী কণ্ঠে কথাগুলো ভেসে আসে। যেন জনম জনম ধরে কোনো এক অধিকারের বন্ধনে বন্দি রজত।
রাতে তো মরতে বসেছিলে। ভাগ্যিস, বাবা তোমাকে দেখেছিলো। কী জ্বর রে বাবা, কপাল ছুঁইলে মনে হয় নিজের হাতখানাই পুড়ে যাচ্ছে।
ওটা কিছু না। এমন জ্বর প্রায়ই হয়। কদিন পর জ্বর আপনাতেই পালিয়ে যাবে।
ওসব কথা জানিনে। জ্বরের অসিলায় এ ঘরে যখন ঢুকেছো। তখন তো সুস্থ হয়েই বের হতে হবে।
রজত উঠে বসলো। চাদর জড়িয়ে বললো, না, আমাকে এখুনি যেতে হবে।
বললেই হলো…যেতে হবে।
না আমি চলে যাবো। না করবেন না।
চলে যাবো, বললেই তো হবে না। সারারাত মাথায় আমি পানি ঢাললাম। আর এখন হুঁশ হতেই বলে কি না চলে যাবে। যেতে দিচ্ছি না শুনে রাখো। অন্ধকারটা কাটলেই বাবা বেরুবে ডাক্তার ডাকতে।

নির্বিকার রজত তাকিয়েছিলো নারীর লাবণ্যময়ী রহস্যাচ্ছন্ন মুখের দিকে। ভাবনার দোলাচালে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে। কে এই মেয়ে? কী নাম? কেন এত মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে? মাতৃস্নেহময়ী মিনারার পর, এই প্রথম কোনো নারী ঘৃণাহীন রূপে উদ্ভাসিত হলো তার সামনে। পৃথিবীতে এতটা ভালো চোখে কেউ তাকে দেখবে তা রজত কখনো কল্পনাও করেনি। জন্মধাত্রী মাকে বরাবরই সে ঘৃণা করতো, কিংবা ভুলে থাকতে চাইতো। কে তার পিতা? রহত আলী, নাকি অন্য কেউ? তবে শারীরিক গঠন ও মুখের আদল বিবেচনায় রহত আলীকেই তার পিতা বলে মনে হয়। মাঝে-মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মায় রজতের মনের গহিনে। সবকিছু তছনছ করে দেবার ইচ্ছে হতো, তারপর মদ্যপান ও নেশার ঘূর্ণিপাকে সবকিছু মিলিয়ে যেতো মেঘের মতো। পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয়ের ধূলি-ঝড় সে মুছে দিয়েছিলো, নিজেকেই নিজের পিতা ভেবে।

রমিজ মুন্সির একমাত্র মেয়ে রুবিনা। দেখতে ভীষণ সুন্দরী! দৃষ্টি আটকে রাখার মতো রূপ! বড়ো হয়েছে বাবা ও আত্মীয়দের স্নেহাদরে। মা থেকেও নেই। বুঝ হবার পর থেকেই রুবিনা দেখে আসছে মা এক ভয়ংকর বস্তু। বদ্ধ উন্মাদিনী! অনেক চিকিৎসা করেও রমিজ মুন্সি স্ত্রীর মানসিক সুস্থ্যতা আনতে পারেননি। সে এক ভিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাস, যা এই গল্পে টেনে আনতে চাইনে, অন্য কোনো গল্পে সে ঘটনা ঠাঁই পাবে। যাই হোক, রুবিনা বড়ো হয়ে আসছে মাকে শেকল বন্দি অবস্থায় দেখে। প্রকৃতপক্ষে রমিজ মুন্সির এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।

দিন চারেক পর রজতের জ্বর কমে আসতে থাকে। প্রথম দিকে এখান থেকে ছুটে পালানোর জন্য মন ছটফট করলেও, মোহ মায়ায় বন্দি হতে সময় লাগেনি। রজতের কাছে নারী চরিত্রের এক বিস্ময় ধরা দেয় রুবিনার হাসি, শাসন-বারণ ও কথা বলার লাবণ্য চক্রে।

সাহেবপুর মডেল থানার মোড়ে ফ্যাকাশে সকাল এসে দাঁড়ায়। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ মিলিয়ে যায় বাতাসের ছকে। মাইজভাণ্ডারী চিতোই পিঠার দোকানে ধোঁয়া উড়িয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে এক বালক। থানা এরিয়ার ভেতরে বাগান ঘেঁষে এক টুকরো আঙিনা। উত্তর কোণে সাধারণ অভিযোগ কেন্দ্র, ঠিক তার পাশে রাখা হয়েছে রজতের লাশ। দারোগার নির্দেশে দু’জন কন্সটেবল লাশটা সদ্য কেনা কফিনের ভেতর পলিথিনের ওপর বিছিয়ে দেওয়া বরফের ওপর রাখলো। বরফসহ লাশ মুড়ে দেওয়া হলো নীল রঙের বিশাল পলিথিনের পরতে। কফিনটা তোলা হলো পিকআপে।

একশো শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে লাশবাহী পিকআপ, সাথে দু’জন কন্সটেবল। টাকঅলা কন্সটেবলটা প্যান্টের ওপর দিয়ে পুরুষাঙ্গের গোড়া চুলকাতে চুলকাতে বললো, হালার পুতে মরার আর টাইম পাইলো না। আজকে আমার স্বমন্ধীর বিয়ে, হাজার চেষ্টা করেও ছুটি কাটাইতে পারলাম না।

পাশে দাঁড়ানো লাল চোখের কন্সটেবলটা বললো, তুই আছত, স্বমন্ধীর বিয়ার আফসোস নিয়া। গত রাইতটা আমার গেলো অঘুমা।
– হালার পুতে দু’দিন আগে বা পরে মরলে কী ক্ষতি হইতো?
– লাশের ধরন দেইখা তো মনে হয়, মিনিমাম দিন পাঁচেক আগে মরছে। তোর স্বমন্ধীর বিয়াত যাওয়া ঠেঁকাইতে লাশের কোনো ঠেঁকা পড়ে নাই। বুঝলি কিছু দামড়া কোথাকার! হে হে হে…।

পিকআপটা ছুটছে। জোড়া সিগারেটের ধোঁয়া সকালের গায়ে বিলীন হতে থাকলো। সে সময় রমিজ মুন্সির বাড়িতে রজত সেরে উঠেছিলো রুবিনার যত্নে। রজতের অতীত-বর্তমান সবকিছু একে একে জানা হয়। নিঃসঙ্গ হবার কারণে রজতকে মেয়ের জামাই হিসেবে ভাবতে খুব মনে ধরে রমিজ মুন্সির। অন্তত এটা নিশ্চিত হয় যে, রজতকে ঘরজামাই হিসেবে রাখা যাবে। ফলে মেয়েকে দূরে পাঠানোর ভয় থাকলো না। খুব সাধারণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় বিয়েটা।

রমিজ মুন্সির ছিলো সামান্য মহাজনী কারবার, খুব সামান্য আয়। রজত শ্বশুরের কাজ-কর্মই নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিলো। মিষ্টি হাসির কলরোল ও আনন্দ ভুবনের অবাক বাসিন্দা বনে যায় রজত। দেড় বছর পর ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলো এক কন্যা সন্তান। রুবিনা মেয়ের নাম রাখে রজনী। পাড়া-ঘরের অনেকেই বলতো, মেয়েটা ঠিক বাপের মতো হয়েছে। টলটলে এক জোড়া চোখ। এক চিলতে হাসি ও ছোটো ছোটো বাহু উঁচিয়ে আকড়ে ধরা মমতা।

একদিন রাতে রুবিনা রজতকে জড়িয়ে ধরে বলে, জানো আমি আজ একটা জিনিস খোঁজে পাইছি।
কী খুঁজে পাইছো?
খুঁজে পাইছি মানে আবিষ্কার করছি।
আরে বাবা, বিজ্ঞানী হইয়া গেলা নাকি? যেমনে কইতেছ।
হ, বিজ্ঞানী না ছাই হইলাম। একখান হারামি বেটি জন্ম দিলাম। মুখের সুরতটাও বাপের মতো। তাও আবার জন্মদাগটাও বাপের মতো ডাইন ঠ্যাঙ্গের উরুতে লইয়া আসছে। হারায়ে গেলেও যেন খুঁজতে পারে। আমার লগে কোনো মিল রাখলো না।
ও আচ্ছা এই কথা!

দু’জনেরই হাসির ঢেউ উপচে পড়ে। রজতও অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ঠিকই বলেছে রুবিনা। রজতের মতো মেয়ের ডান উরুতেও হুবুহু একই রকম জন্মদাগ। দিনগুলো ভালো কাটছিলো। কিন্তু সুখের রেলগাড়ি খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। সরল রেখা ক্রমেই বেঁকে যেতে থাকে আর জীবনের গতি আছড়ে পড়ে যন্ত্রণার দিগন্তে। এক রাতে রমিজ মুন্সির গোডাউনে ডাকাত পড়ে। দু’জন চাকর কোনো ক্রমে পালিয়ে এসে খবর দেয়। রজত ও রমিজ মুন্সি মোটরসাইকেলে চড়ে ছুটে যায় ডাকাত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। দু’জনের হাতেই সাধারণ দা। ডাকাতরা তখন নির্বিঘ্নে মালামাল লুটপাট করে নৌকা বোঝাই করছিলো। শেষের দিকে বাধার মুখে দাঁড়ানোটা প্রত্যাশা করেনি ডাকাত সর্দার কেরামত। গালাগাল ও বাক্য বিনিময়ের মধ্যেই রমিজ মুন্সি কেরামতের কাঁধ বরাবর দায়ের কোপ বসিয়ে দেয়। পরের মুহূর্তে কেরামত হাত চালাতেই, রমিজ মুন্সির মাথাটা ধড় থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য রজত সহ্য করতে পারেনি। কেরামতের হাত থেকে রাম দা কেড়ে নিয়ে এলোপাথারি ভাবে কোপাতে থাকে। কেরামতের ডানহাতটা কাটা পড়ে, তারপর সে কোঁকাতে কোঁকাতে নৌকায় আশ্রয় নেয়। সে রাতে ডাকাত সর্দারের এক ছেলেসহ চারজন ডাকাতের লাশ পড়ে। রজতও আহত হয়, বাম পায়ে গুরুতর জখম। অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটে ডাকাত দল। কেরামত চিৎকার করে বলেছিলো, ‘আমারে সন্তান হারা করলি, তোরে ছাড়মু না।’

ঐ রাতের পর থেকে সবকিছু পাল্টে গিয়েছিলো। রুবিনার হাসি কোথায় মিলিয়ে যায়, তা কেউ জানে না। রজত হয়ে ওঠেছিলো কেরামত ডাকাতের প্রধান টার্গেট। সর্বক্ষণ এক অজানা ভয় ঘিরে রাখে তাকে। মানসিক অস্বস্তি তার জন্য তখন এক ভয়াবহ শত্রু! রুবিনা স্বামীর জীবনের কথা চিন্তা করেই সবকিছু বিকিয়ে বাপের ভিটা ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরে। আর পাগলি মাকে রেখে যায় দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি, প্রতি মাসে খরচের টাকা পাঠানোর শর্তে। শহরে এসেই রজত একটা ঘোড়ার গাড়ির হেল্পার হিসেবে সামান্য কাজ জুটিয়ে নেয়। বিকল্প কাজের জন্যও এদিক-ওদিক চেষ্টা চলতে থাকে। স্যাঁতস্যাঁতে বস্তিতে স্বল্প টাকায় একটা ঘর ভাড়া নেয়। এভাবেই অনটন সংকটের দিন-কাল ধুঁকে ধুঁকে চলছিলো। অল্প আয়ে সুখ আহরণের প্রচেষ্টা। সে সুখের দৌড় খুব বেশি দূর নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। গল্পটা শেষ করতে হবে, যতদ্রুত সম্ভব রজতকে আত্মহত্যার ফাঁসি গলায় পরাতে পারলেই বাঁচা যাবে। দীর্ঘসময় এই একটা গল্পের বক বক ভাল্লাগছে না। কী পাঠক মহোদয়, রজতের জন্য কি হালকা ধাঁচের চিনচিনে মায়া কাজ করছে? লাভ নেই। আপনার মনোভাবনা ভিন্ন হলেও পুঁজিপতির পুজো, রাজনীতির বিষাক্ত গ্রাস আমাদের পিছু ছাড়ছে না।

রজতের লাশ পোস্টমর্টেম শেষে থানায় নিয়ে আসা হয়। রিপোর্টে, লিভারে মদের উপস্থিতি, মাথায় সামান্য জখম ও ডানপায়ে ফুলে ওঠা আঘাতের দাগ। লাশের কারণে দারোগা পড়লেন বিপদে, এখন পর্যন্ত কেউ রজতের লাশ নিতে আবেদন করেনি। লাশটাকে বেওয়ারিশ বলারও উপায় নেই। কারণ, মরহুম রহত আলীর বাড়ি থেকেই লাশটা উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও ওই বাড়িতে তখন কারোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। জানা যায়, রহত আলীর দুই স্ত্রী কেউ জীবিত নেই। ওদের কোনো সন্তানেরও হদিস মেলেনি। রজতের উত্তরসূরি কেউ থাকুক বা না থাকুক, আত্মীয়-প্রতিবেশী তো কেউ থাকবে। গাঁয়ের লোকজনই তো লাশের সংবাদ থানায় দিয়েছিলো। সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চায়, কেউ দায়িত্বটুকু নিয়ে লাশটা কবর পর্যন্ত পৌঁছাতে রাজি হয়নি। দারোগার ইচ্ছে করছে সবকটাকে নেঙটু করে পেটাতে, অথচ এই কারণে শাস্তি দেবার রাইটস তার নেই।

মির্জানগরের চেয়ারম্যানের সাথে ফোনালাপ শেষে দারোগার নির্দেশে সিদ্ধান্ত হয় পুরো ইউনিয়ন জুড়ে মাইকিং করার। ঘোষণা করা হয়, উপযুক্ত আত্মীয়-স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে, অতি শীঘ্রই যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। পরে আরো একটি সিদ্ধান্ত প্রচার পায়, আগামী পনেরো দিন কেউ লাশ নিতে না এলে, থানা কর্তৃপক্ষ জজকোর্টকে জানিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করবে। দারোগা সাহেব কন্সটেবলদের ডেকে লাশ পুনরায় হাসপাতালের মর্গে রেখে আসার নির্দেশ দেন। কন্সটেবলদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে দারোগা বললেন, ভাবিস নে, একটু শ্রম দে, যে শালা লাশ নিতে আসবে, তার কাছ থেকেই আদায় করে নিস, আমি বলে দেবো নে।

টাকওলা কন্সটেবলটা বিড়বিড় করে বললো, শালা বাইনচোত! কী যে বলে দিবে, আর কী খাবে। সবই হাড়ে হাড়ে জানা আছে আমার। আকামের দোকানদারি কী দরকার ছিলো আইজ, লাশটা থানায় আনবার। সারাদিন গেলো ম্যাজিস্ট্রেট তো আইলো না।

ঘোড়ার গাড়ির হেল্পার থেকে বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ পায় রজত। পুরনো কাজটা আবার নতুন করে পাওয়া। বছর খানেক যাবার পর সে ড্রাইবারের আসন লাভ করে। দিনকাল এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে, কোনো প্রকার ক্ষতি হতো না। সে দিনটা ছিল শনিবার। ভোরে কাজে বেরুবার পথে বাধা দিয়েছিলো রুবিনা। অকারণ বাধা হেসে খেলে উড়িয়ে দেয় রজত।

হাইওয়ে রোডে পুলিশ গাড়ি থামায়। মাদকের অভিযোগ তোলে পুরো গাড়ি চেক দেয় তন্ন তন্ন করে। পুলিশ সার্জেন্ট কোনো কিছু খুঁজে পায় না। বরং যাত্রীদের বিরক্তির রোষে গাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। গাড়িটা তখন চলতে শুরু করেছিলো। ফ্লাইওভার পেরুবার পর, গাড়িটা আবার থামানো হয়। এখানকার পুলিশ যাত্রীদের নেমে যেতে বাধ্য করেন। তারপর আবারো সেই মাদক বহনের অভিযোগ। এবার গাড়ি চেক করে এক ডজন ইয়াবা পাওয়া যায়। রজত কিছুই বুঝতে পারছে না, কী হচ্ছে এসব! সে চিৎকার করে ওঠে, না সব কিছু ষড়যন্ত্র!

এবার দেখা যায় সেই আগের সার্জেন্টটা মোটর সাইকেলে চড়ে আসছেন, মুখে মৃদু হাসি!
রজতকে টেনে নেওয়া হয়েছিল পুলিশ বক্সের ভেতর! তখনো রজত চিৎকার করে বলছে, কেন আমাকে এ্রভাবে ফাঁসাতে চাচ্ছেন?
সার্জেন্ট হেসে ফিসফিসিয়ে বললো, ঠিকই ধরেছিস। ফাঁসাতে চাচ্ছি! তিন লাখ টাকা দে, ছেড়ে দেবো তোকে।
অন্তত কী অপরাধ করেছি সেটা তো বলবেন।
এবার সার্জেন্ট সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বাইরে দাঁড়ানো এক কন্সটেবলের দিকে তাকিয়ে বলে, এই শালাকে তার অপরাধটা কী বলে দাও তো।
অল্প বয়সী কন্সটেবল এসে বলে, জি স্যার।
সার্জেন্ট বাইরে বেরোতেই কন্সটেবল রজতের কলার চেপে ধরে বলে, হালার পুত, অপরাধ তো তুই করিসনি। অপরাধ করছি আমরা, করছে আমঙোর নেতারা।
রজত ভয়ে ভয়ে বলে, স্যার, কিছুই তো বুঝতে পারছি নে।
বারো লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরি নিছি। সে টাকাটা কি তোর বাপ পরিশোধ করবে? ব্যাংকের লোনটা কে শোধ করবে শুনি? স্যার তো তিন লাখ চাইছে, তিন না পারোছ এক লাখ দে। তেজ দেখাবি না, ভিত্রে ঢুকায়া দিবাম
রজতের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। কিছু বলতে পারে না।
কন্সটেবল শেষে বলে, পঞ্চাশ হাজার দিতে পারবি?
রজত তার কান্না ভেজা কণ্ঠে পরিবারের সবকিছু বলে কয়েও সে পুলিশি মায়া অর্জন করতে পারেনি।
শেষে সার্জেন্ট শুধু বললো, ব্যাড লাক! মুরগি হয়ে ধরা পড়েছিস, কিচ্ছু করার নেই! টাকা না থাকলে চালান করে দেবো। জেল-হাজত আদালত আর উকিল মোক্তারের কাম।

দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর একটি উড়ো খবরের মাধ্যমে রজতের খোঁজ পায় রুবিনা। অনেক চেষ্টার পর জেলখানায় সাক্ষাতের সুযোগ হয়। রুবিনা সবকিছু শুনে এক রাজনৈতিক নেতার দ্বারস্থ হয়, যিনি এই শহরেরই সিটিকর্পোরেশন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। নানা আশ্বাস ও দয়া দেখিয়ে রুবিনাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়, বলে রজতকেও জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে। দুর্বলকে গ্রাস ও সম্ভোগের নেশায় সুবিধাকামীরা বরাবরই ওঁৎ পেতে থাকে। রুবিনা সে নেতার হাতে তেমনই এক শিকার। সভ্য মুখোশ ও সাধুসমাজের কাছে চিৎকার, নগ্ন ও বীভৎস দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে গল্পের কলেবর বাড়াতে চাচ্ছি না, কিংবা কারোর জন্য সেক্স ফ্যান্টাসির রসদ যোগাতেও চাচ্ছি না। মানবিক মননের কেউ যদি এখানে থাকেন রুবিনার রক্তাক্ত কষ্টটুকু বুঝে নিবেন প্রত্যাশা করি। তারপর রুবিনার কী হয়েছিলো? প্রশ্নটার সহজ উত্তর, কিছুই জানি না। কেবল জানি রজতের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিলো।

আঠারো বছর পর রজত জেল থেকে ছাড়া পায়। শহরের আনাচে কানাচে রুবিনা ও রজনীকে খুঁজে বেড়ায়। বস্তিতে সেই আগের লোকজনও নেই যে, জিজ্ঞেস করে জানবে। পরিচিত একজন বিদ্বেষ ঢেলে বলেছিলো, তোর বউ তো, নেতার সাথে লাইন মেরেছে রে! এখন কোথায় আছে কে জানে!

একখণ্ড ঘৃণা নিয়ে রজত ফিরে যায় গাঁয়ে। এসে দাঁড়ায় রহত আলীর ভিটেতে। সেখানে কেউ নেই। রহত আলী ও তার নিঃসন্তান দু’জন স্ত্রী গত হয়েছে অনেক আগেই। রজতের হঠাৎ উপস্থিতিকে রহত আলীর ভাইপোরা ভালো চোখে দেখেনি। তার মানে এই নয়, ওরা রজতকে হত্যা করেছে। কিন্তু দারোগার মাথায় এই সন্দেহটাই বাসা বেঁধে আছে।

রজত গাঁয়ে ফেরার পর সেই পুরোনো নেশা-নারী-যৌনতার জীবনে ফিরে যায় অনায়াসে। জীবন সংসারের সবটুকু স্মৃতি সে তছনছ করে মুছে দিতে চেয়েছিলো সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে। কখনো আত্মহত্যার মতো ভাবনা তার মাথায় আসেনি। গাড়ি চালিয়ে যা কটা টাকা আয় রোজগার করতো, সবটুকু ঢেলে দিতো বেশ্যার পদতলে।

এক সন্ধ্যারাতে রজত দুশো টাকা নিয়ে অচেনা এক পাড়ায় ছুটে যায় মদ ও নারী মাংসের সান্নিধ্যে। পকেটে টাকা কম থাকায় সবাই এড়িয়ে যাচ্ছিলো। তখন এগিয়ে আসে একুশ-কুড়ি বছরের এক কালো যুবতী, শর্ত আরো একশত টাকা আগামীকাল সন্ধ্যায় পরিশোধ করে যেতে হবে। মেয়েটি রজতকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়, বসায় ছোট্ট একটা টিনশেডের ঘরে।

মেয়েটা বলে, জানো তো আজকাল ভীষণ গরম পড়েছে। কাপড় গায়ে রেখে টিকে থাকাই দায়। দেখো না, শাড়িটা রাখতেই পারলাম না। তুমি বসো, আমি ওপাশ থেকে কোনো জল খাবার পাই কিনা দেখে আসি। বাংলা হলে চলবে?

রজত নিশ্চুপ হয়ে বসা। যেন রুবিনাকে দেখছে, অথচ সবই ঘোর। মনের ভেতর ভুল ভাবনার রোষানল জ্বলে ওঠে। বলে ওঠে, মদ খেয়েই এসেছি। এখন তোকে খাবো।
এই জবাকে এখনো পর্যন্ত কেউ আঁশ মিটিয়ে খেতে পারেনি। তার আগে পুট্টুস, আউট! দেখবো নে কতদূর ছুটতে পারো।
এত টকটক করে কথা বলিসনে। এখনি এইদিকে আয় বলছি…।
আঃ এত অস্থির হচ্ছো কেন? সারা রাতই তো পড়ে আছে, তখন তো মজা করবো।
না, এখনই আয়।
ঝড়-ঝঞ্ঝা ঝাপটা, মাংসে কামড় বসানো শেষে পতনের নিশ্বাস রজতকে ক্লান্তির দিকে ঠেলে দেয়। মোচড় দিয়ে ওঠে জবা।
কতদূর যেতে পারবি, তা আগেই বুঝেছিলাম। এখন চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি স্নান সেড়ে নেবো।

উলঙ্গ শরীরে কাপড় জড়ানোর সময় হঠাৎ রজতের চোখ পড়ে জবার ডান উরুতে, একটা দাগ! রজত দু’চোখে অন্ধকার দেখে, শরীরে পাথুরে অবসাদ আঁকড়ে ধরে। মুখে শুধু উচ্চারণ করে, রজনী!
থমকে যায় জবা। তারপর গর্জে ওঠে আপন স্বভাবে।
কে গো তুমি? আমার আসল নামটা পর্যন্ত জেনে ফেলেছো। আর কী কী জানো জানি নে। জেনেও লাভ নেই, হা হা হা, খোদার দুনিয়ায় আমার এমন কেউ নেই যে, আমার বেশ্যাগিরি ফাঁস করবে। পেটের দায়ে খেটে খাই।
‘রুবিনা’ শব্দটা উচ্চারণ করে রজত।
মেয়েটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো দাউ দাউ জেগে ওঠে।
তুই কে রে বেটা? আমার মার নামটাও জানিস। বুঝেছি মোল্লার মাগির কাছ থেকে জেনে এসেছিস? যতই ভয় দেখাস টাকা আদায় করতে পারবি নে, বলে দিলাম। কার কাছে ফাঁস করবি? কেউ থাকলে তো!
রুবিনা কোথায়, জলদি বল!
একদম চিৎকার করবি না, শালা। এটা আমার ঢেরা, টাকায় শরীর খেতে এসেছিস, খাওয়া হয়ে গেছে, এখন ভাগ!
যাবো না, বল রুবিনা কোথায়?
ঐ মরা মাগির খোঁজ নিয়ে তোর কী হবে? মায়ের কাছেই শরীর বেচা শিখেছি, আর আমাকে একলা ফলায়া হারামি মাগি ম্যালেরিয়া ব্যারামে মরেছে! বাপটার নামও ভুলে গেছি, জেলে মরেছে না জীবিত আছে আল্লাই জানে। বেঁচে থাকলেও এই পাপের মুখ তারে দেহাবো না।
জবা হু হু করে কেঁদে ফেলে।
জবার উরুতে জন্মদাগ দেখার পর থেকেই পাপবোধের তীব্র ছোবলে রজতের মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে একখণ্ড ফাঁসির দড়ি। সে দড়ির টুকরোকে আরেকবার শক্ত করে পাকিয়ে দিলো বেশ্যালয়ের এক বৃদ্ধার পরিচয়।

সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো। কেউ রজতের লাশ নিতে এলো না। পুলিশ গিয়ে রজতের চাচাতো ভাইদের ধরে আনলো। কেউ মার্ডার করেছে কিনা এই প্রশ্নের ভয় দেখিয়ে দিন দুয়েক দিন হাজতবাসও করালো। বউয়েরা এসে দারোগার হাত-পায়ে ধরে, পকেটে টাকা পুরে দিয়ে, কন্সটেবলদের সবরকম হাতখরচা দিয়ে স্বামীদের ছাড়িয়ে নিলো, তবু কেউ রজতের লাশের দায়িত্ব নিলো না।

অতঃপর দিন চারেক পরে এক বৃদ্ধা থানায় এসে হাজির হলো রজতের লাশ নিতে। বৃদ্ধার সাথে একটি মেয়েও ছিলো। মেয়েটা লাশ দেখেই চিনতে পারে। মনে পড়ে সে রাতের ঘটনা। মেয়েটির কাছে লাশের লোকটা এক রাতের খদ্দের ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়।

লাশবাহী ভ্যানগাড়িটা ছুটছে!

বিজ্ঞাপন
সৌর শাইন

সৌর শাইন

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও তরুণ গল্পকার।

লেখকের অন্যান্য লেখা

বিজ্ঞাপন


সদ্য প্রকাশিত

নেয়পায়াসাম
অনুবাদ

নেয়পায়াসাম

আদনান সহিদ
অক্টোবর ২২, ২০২০
0

[মালায়লাম ভাষার শীর্ষ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯) অন্যতম। তাঁর জন্ম কেরালার দক্ষিণ মালাবারের পুণ্যাউরকুলামের এক রক্ষণশীল পরিবারে। বাবার চাকুরিসূত্রে শৈশবের...

যতীনের লোক-জ্যোতি

যতীনের লোক-জ্যোতি

অক্টোবর ১৮, ২০২০
‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ : একটি উত্তর উপনিবেশীয় বিশ্লেষণ

‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ : একটি উত্তর উপনিবেশীয় বিশ্লেষণ

অক্টোবর ১০, ২০২০
ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা

ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
বিষজন্ম বিষমৃত্যু

বিষজন্ম বিষমৃত্যু

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০
কেঁদেও পাবে না তাকে

কেঁদেও পাবে না তাকে

সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

এ মাসের সর্বাধিক পঠিত

ঢোঁড়াই চরিত মানস : প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য ও অধিকার-সচেতনার গল্প
বইকথা

ঢোঁড়াই চরিত মানস : প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য ও অধিকার-সচেতনার গল্প

সাফি উল্লাহ্
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
0

জীবন অন্বেষী ভারতীয় ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫) রচিত অল্প-পঠিত অথচ বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীতে অনন্য উপন্যাস ‘ঢোঁড়াই চরিত...

শার্ল বোদলেয়ার : আধুনিক কবিতার পিতা

শার্ল বোদলেয়ার : আধুনিক কবিতার পিতা

জুলাই ১, ২০২০
জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা

জালাল উদ্দিন রুমির কবিতা

জুলাই ২৯, ২০২০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’ : উপেক্ষিত প্রাচ্য পুরাণ এবং একটি বিতর্কিত বিনির্মাণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’ : উপেক্ষিত প্রাচ্য পুরাণ এবং একটি বিতর্কিত বিনির্মাণ

জুলাই ৯, ২০২০
রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোত

রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোত

আগস্ট ২১, ২০২০
বিজ্ঞাপন
লেখা পাঠানোর ঠিকানা ও যোগাযোগ
pratiswik2020@gmail.com
অলংকরণ : মাকসুদুল হাকিম

প্রকাশিত লেখার বক্তব্য সম্পর্কিত দায় সংশ্লিষ্ট লেখকের

Design by OneHost BD ©2020 সর্বস্বত্ব সংরক্ষণকারী প্রাতিস্বিক

কিছু পাওয়া যায়নি
সব লেখা দেখুন
  • হোম
  • লেখকসূচি
  • কবিতা
  • কথাসাহিত্য
    • গল্প
    • উপন্যাস
  • নাটক
  • প্রবন্ধ
  • বইকথা
  • গদ্য
    • মুক্তগদ্য
    • অন্যগদ্য
  • অনুবাদ
  • চলচ্চিত্র
  • চিত্রকলা
  • সাক্ষাৎকার
  • অনূর্ধ্ব ২৭
  • বিশেষ সংখ্যা
  • সাহিত্য সংবাদ

© 2020 সর্বসত্ব সংরক্ষকারী প্রাতিস্বিক.