তারাপাশা গ্রামের মাথায়, সুরাই নদীর পাড় দিয়ে যে সড়কটা আশেপাশের রাড়ইল, পিতাম্বুর কিংবা তাড়ল হয়ে দিরাইয়ে চলে গেছে, সেখানে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। এই পৌষের রাতের জেঁকে বসা শীত কিংবা উত্তর থেকে বয়ে আসা বরফ শীতল হওয়া তারাপাশা গ্রামের মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে জনাকীর্ণ হয়ে যায় সম্পূর্ণ সড়ক। এক সময় জনতার ঢল সামনের দিকে চলতে থাকে। গ্রামের মানুষগুলো আনন্দ মিছিল নিয়ে চলতে থাকে আশেপাশের গ্রামগুলোর দিকে। আজকের এই আনন্দ মিছিল শুধু তারাপাশার জন্য নয়, এটা গোটা দিরাই শাল্লার প্রত্যেকের জন্য আনন্দের। হাওর-বেষ্টিত এই অঞ্চলের মানুষের আজকের এই আনন্দের উৎস সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়াল মাস্টারের জিতে যাওয়া। স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশের বড়ো দুই দলের কেউ ব্যতীত ভিন্ন কেউ জিতলো, জিতলেন দিরাই কলেজে দীর্ঘ চল্লিশ বছর শিক্ষকতা করা আমাদের আউয়াল মাস্টার। এই যে এই অঞ্চলের মানুষের এমন একটা ভোট-বিপ্লব হলো, সেটা গাঙ, বিল, জলমহাল লুটে খাওয়া দুই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণের নীরব বিস্ফোরণ, এই ভোট-বিপ্লব নেতাদের অবহেলায় হাওরের বাঁধ ভেঙে বিস্তৃত অঞ্চল ডুবে যাওয়ার বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ, এই ভোট-বিপ্লব জলমহাল নিয়ে বিরোধ লাগিয়ে সাধারণ মানুষ খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সাধারণ মানুষ অন্তঃপ্রাণ আউয়াল মাস্টারকে নিজেদের এমপি হিসেবে পেয়ে এই অঞ্চলের মানুষের আনন্দ বাঁধভাঙা। বিশাল জনতার এই আনন্দ মিছিল আশেপাশের গ্রামগুলো ঘুরতে ঘুরতে যখন মিলনগঞ্জ বাজারে আসে, ঠিক তখনি, তখনি সবাই নতুন একটা খবর শুনতে পায়।
খবরটা শুনে জনতার স্রোত যেন আচমকাই বড়ো একটা পাথরের সাথে ধাক্কা খায়। এমন খবর শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। খবরটা শুনে দুঃখের একটা ছায়া সবার চোখে মুখে ফুটে ওঠে। কিন্তু পর-মুহূর্তেই জনতার ভিড় থেকে সুফি মণ্ডল যখন বলে উঠলো, ও বেটাইন, ই খবর ইগু দিছে হারিস ফাগলে, ইগুর মাতের কুনু টায় টিকানা আছে নি? দেখও কিবান আন্দু মাতের, হাফিজরে আমি আচরের আযানের আগখানও দেখছি ভুট দিয়া বাড়ি বায় যাইতাচের।
সুফি মণ্ডলের কথাগুলো গ্রামের মানুষদেরকে বড়ো স্বস্তি দেয়। যেন-বা কোনো হাওরের বাঁধের ফাটল ধরার খবর পাওয়ার পরপরই আবার সেই খবর মিথ্যে হয়েছে, তেমনি স্বস্তি দেয়। কিন্তু খবরটা বেশি সময় স্বস্তি দিতে পারে না। বাঁধে ফাটল ধরেই, বাজারের কাপড়ের দোকানি ছনর মিয়ার মুখে এবার শোনা যায় দেওয়ান হাফিজের মৃত্যুর খবর!
এরপর আমরা দেখতে পাবো গ্রামের মানুষগুলো সময়ের হিসাব করে। কত বছর আগে দেওয়ান হাফিজ সর্বশেষ তারাপাশায় ছিলেন? বিশ বৎসর হয়ে গেছে। তাঁর বাবা দেওয়ান আশরাফ উদ্দিনের মৃত্যুর পর, তাঁর চল্লিশার পর, দেওয়ান হাফিজ আর কখনো তারাপাশায় আসেনি। মানুষগুলো ভাবে, মৃত্যুই হয়তো তাঁকে তাঁর গ্রামে টেনে নিয়ে এসেছে। শত হোক, জন্মের সময়ে যে মাটির ঘ্রাণ সে পেয়েছিলো সেই মাটির ঘ্রাণ শুকেই যে একজন মানুষ মরতে চায়। দেওয়ান হাফিজও হয়তো তাই চেয়ে ছিলেন।
দেওয়ান হাফিজের মৃত্যুর সংবাদে মিছিলে থাকা তারাপাশার মানুষগুলো বিষণ্ন হয়ে পড়ে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে চাঁদের আবছা আলো এসে পড়ছিলো গ্রামের মানুষদের ওপর, সেই আবছা আলোই যেন সবার গায়ে দুঃখ হয়ে লেপটে গিয়েছিলো। গ্রামের মানুষদের এই দুঃখবোধ কিংবা বিষণ্নতার ভেতরেও যদি আমরা আরেকটু গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করি তখন দেখবো, মৃত্যুর সংবাদে কেউ কেউ একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছে। আমরা দেখবো একসময় দেওয়ান হাফিজদেরকে মক্তবে ঝালি বেত হাতে নিয়ে, সুর করে আলিফ যবর আ, বা যবর বা বলে যিনি পড়তেন সেই সৈয়দ ক্বারিকে দুঃখ একটু বেশিই পেয়ে বসে। হয়তো দেওয়ান হাফিজের ছোটোবেলার স্মৃতি এসে হামলা চালায় তাঁর চোখের সামনে। আমারা দেখেছি ক্বারি সাব বড়ো ফ্রেমের চশমা ব্যবহার করেন, চোখে কম দেখেন, রাতের বেলায় একটু বেশিই ঝাপসা দেখেন, কিন্তু এখন আমরা দেখবো তিনি তাঁর চোখ দিয়ে তেমন কিছুই দেখছেন না, চারদিকে শুধুই ধোঁয়াশা। আমরা সুবেন্দু ঠাকুরকে দেখবো, তাঁর মন পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। তখন তাঁর অকাল-প্রয়াত বন্ধু দেওয়ান আশরাফের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বর্ণালি সময়ে এক সাথে দুজনের যুদ্ধ করার কথা। বন্ধুর স্মৃতি, আর সেই বন্ধুর সন্তানের অকাল মৃত্যুতে আমরা সুবেন্দু ঠাকুরকে দুঃখে নিমজ্জিত হতে দেখবো। এমন সময় গ্রামের মানুষগুলো শুনবে কেউ একজন বলছে, লাশ দেওয়ান বাড়ির ফচমের ফুকরিত ফুইল্লা বাইছে!
কথাটা শোনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যাবে। সপ্তাহ দিন পার হয়নি দেওয়ান হাফিজের একমাত্র ছোট্ট মেয়ের লাশ এই পুকুর থেকে ভেসে উঠেছিলো, এরই মধ্যে দেওয়ান হাফিজের মৃত্যু, তাও আবার সেই একই পুকুর থেকে!
দেওয়ান হাফিজের মেয়ের মৃত্যুতে গ্রামবাসী এতটা দুঃখে আক্রান্ত হয়নি, সে মৃত্যু নিয়ে এত আলোচনাও হয়নি। কিন্তু আজ, তারাপাশার এই আনন্দের দিনে, পর পর দুটি মৃত্যুতে এই মানুষগুলো দেওয়ান হাফিজ কিংবা তাঁর ছ’বছরের মেয়ে ব্যতীত অন্যকিছু ভাবতে পারে না। মৃত্যু এমনি যে তা মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়, বর্তমান থেকে অতীতে নিয়ে যায়, কখনো কখনো মৃত্যুতে মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত হয়। মৃত্যু মানুষকে স্তব্ধ করে বাস্তব থেকে বহুদূর নিয়ে যায়। তারাপাশার মানুষগুলো ভুলে যায় তাঁদের একজন মানুষ, একদম নিজেদের মানুষ, আজ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন এবং তাঁরা এখন একটা আনন্দ মিছিলে আছে। তাঁরা পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু এই দুই মৃত্যু নিয়ে কথা বলে।
আমরা দেখতে পাই গ্রামের মানুষেরা স্মৃতিচারণ করে, বাপ মেয়ে দুজনেরই। তখন আমাদের চোখেও স্মৃতিগুলো উঁকি দেয়; আমরা তখন দেখি, দেওয়ান হাফিজ হাড় কাঁপানো শীতের সকালে, কুয়াশাকে ভেদ করে আসা এক চিলতে সোনালি রোদে, বাড়ির উঠানে মেয়েকে কোলে নিয়ে বেতের পিঁড়িতে বসে আছেন। আর কোনো এক আদ্যিকালে দাদা কিংবা দাদির কাছ থেকে শোনা শীতের ছড়া মেয়েকে শোনাচ্ছেন, মেয়েও তাঁর বাবার সাথে বলে চলছে :
রইদ রাজারে রইদ তুলি দে
ইন্দুবাড়ির সুন্দর কইন্যারে চাল তুইল্যা দে
গাছের তলে কাটাটুটি
গাই ফড়াইছে ধলা ঢেকি
গাইর নাম চম্পা, বাছুরের নাম ফুল
উঠান ফাটাইয়া রইদ তুল।
এক সময় গ্রামের মানুষেরা দেওয়ান বাড়ির এই দুই মৃত্যুর কথা বলতে বলতে দেওয়ান বাড়িতে গিয়ে পৌঁছিবে। সবার সাথে দেওয়ান বাড়ির উঠানে গিয়ে আমরা উঠানের মাঝখানে একটা বাঁশের খুঁটি সাথে ঝুলানো একশো ওয়াটের উলঙ্গ একটা বাল্ব জ্বলে থাকতে দেখবো। অদূরে, উঠানের এক কোনে একটা লম্বা বেঞ্চটিতে দু’তিন জন মুরুব্বিকে বসে থাকতে দেখবো। তাঁদের চোখে ঘুম, বার বার সজাগ থাকার চেষ্টা করবেন, কখনো কখনো সাদা সফেদ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে একজন আরেকজনের সাথে একটু আধটুকু কথা বলবেন। আমরা তখন দেখবো উঠানের এক কোনে, চারপাশ ত্রিপল দিয়ে আড়াল করে রাখা জায়গা থেকে পানির স্রোত গড়িয়ে আসছে। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না, এখানে লাশ ধোয়া হয়েছে। লাশ ধোয়া হয়ে গেছে শোনে দুই একজন বাদে সবাই লাশ দেখার জন্য ঘরের ভেতরে লাশ রাখা ঘরে গিয়ে ঢুকবে। তখন আগর বাতির তীব্র করুণ ঘ্রাণ আপনাদের নাকে এসে বারি খাবে সেই সাথে ভেতরের ঘর থেকে কয়েকটি মেয়েলি কণ্ঠের কান্না আর বিলাপের সুর আপনাদের কানে এসে ধাক্কা খাবে। কখনো কখনো শুনবেন কোনো এক মধ্য বয়স্ক মহিলা কান্না জড়ানো গলায় কাঁদতে মানা করছেন,খাইন্দ না গ সুনা মাই অখল, আল্লার গেচে দুয়া করও, খান্দিও না, খান্দিলে লাশে খষ্ট ফাইব। কিন্তু আমরা দেখবো মধ্য বয়স্ক মহিলার কথাটা কাঁদতে থাকা কেউ আমলে নিচ্ছে না। তাঁরা অঝোরে কেঁদে চলছে। একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কেউ কাঁদবে না এটা তো হতে পারে না! মৃত্যুতে ইহজগতে একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তিটাতো এই কান্নাই, হয়তো সব মানুষই চায় তাঁর মৃত্যুতে অন্য মানুষেরা কাঁদুক, অনেক মানুষ কাঁদুক, অনেক অশ্রু ঝরুক, তাঁকে হারানোর বেদনাটা সবাই অনুভব করুক, বিলাপ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁকে ফিরে পাবার কথা বলুক। সেজন্যই হয়তো এই মেয়েলি কণ্ঠগুলো কেঁদে কেঁদে লাশের রাজকীয় বিদায় দিবে।
কান্না, বিলাপ সবকিছু ছাপিয়ে গ্রামের মানুষের কানে তখন চৈত্রের দুপুরের মতো স্থির, কোন শত কালের সেই মিহি মসলিন কাপড়ের চেয়ে মিহি সুরে পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত এসে পৌঁছিবে। একসময় গ্রামের মানুষ লাশের মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে লাশ দেখবে, কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কেউ কেউ হয়তো তখন বলবে, আল্লায় দেওয়ান সাবরে বেস্ত দেওউক্কা, তাইন বরও বালা মানুষ আছলা রে ব, কুনু ফেছ টেছও আছলা না, অতবছর ফরে বাড়িত আইয়াও থাখতা ফারলা না, নিলাগি আল্লায়।
এইতো, এইতো এই কথাগুলোই দেওয়ান হাফিজের ইহজীবনের সকল অর্জন! এভাবে গ্রামের মানুষেরা এক এক করে লাশ দেখে চলে যাবে। এক সময় রাত যখন আরো গভীর হবে, ভেতর বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ যখন কমে আসবে, কোরআন তিলাওয়াতের সুর যখন মিহি থেকে আরো মিহি হয়ে যাবে তখন আমাদের চোখ পড়বে লাশ রাখা ঘরের এক কোনায় দু’তিন জন মানুষে ঘিরে থাকা, বেতের পিঁড়িতে বসে থাকা সত্তার পিরের ওপর।
সত্তার পিরকে আপনারা চিনবেন না, তিনি এ গ্রামেরই। শুভ্র চুল, শুভ্র দাড়ির সত্তার পির অন্যান্য পিরদের মতো অন্য কোনো পিরের খলিফা না হয়েও তিনি পির! তারাপাশা, টঙ্গর, রাড়ইল জারলিয়া, হাতিয়া, পিতাম্বুরসহ আশেপাশের সব গ্রামের সবার কাছেই তিনি একজন পির। গ্রামে তাঁর নামে অনেক কথাই প্রচলিত আছে, বলা হয়ে থাকে তিনি চল্লিশ জিনের বাবা এবং তিনি প্রতি চল্লিশ দিন পর পর চার দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান। গ্রামবাসীর ধারণা তিনি সম্ভবত এই চারদিন জিনদের সাথেই কাটান। গ্রামে সত্তার পিরকে নিয়ে আরো অনেক কিছুই প্রচলিত আছে, তবে সেই সব আমাদের আপাতত না জানলেও চলবে। আমরা বরং ধরে নেই সত্তার পির একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান মানুষ, যিনি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন; যিনি চাইলেই আমাদের সামনে যে কারো অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই হাজির করাতে পারেন। এখন আমরা নজর দেই লাশ রাখা ঘরের এক কোনায়, যেখানে বসে আছেন আমাদের সত্তার পির।
সময় একটু একটু করে চলে যাচ্ছে। সত্তার পির নীরবে বসে আছেন, তাঁর আশেপাশে বসে থাকা গোটা চারেক মানুষ সত্তার পিরের নীরবতায় উশখুশ করে। সত্তার পিরের নীরবতা দীর্ঘ হয়, পাশের মানুষগুলো শীত থেকে বাঁচার জন্য সোয়েটারের পকেটে হাত ঢুকায়। এমন সময় হঠাৎ সত্তার পির কথা বলা শুরু করেন। তাঁর গলায় কিছু একটা ছিলো, যা মানুষকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে। তাঁর কথার ভঙ্গিতে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তিনি সাধারণ কেউ নন।
সত্তার পির কথা বলছেন। তাঁর কথা শুরুর সাথে সাথে আমরা সময় নিয়ে বড়ো বিভ্রান্ত হয়ে যাই, আমাদের মনে হয় আমরা কখনো অতীতে চলে যাচ্ছি আবার কখনো আমরা মুহূর্তের ভেতরে বর্তমানে চলে আসছি। একসময় আমাদের এই বিভ্রান্তিটা কেটে যায়। হঠাৎ অন্ধকার থেকে আলোতে আসলে যে রকম চোখ ধাঁধিয়ে যায়, আমাদেরও সেরকমই হয়েছিলো। এখন তাঁর কথা আমাদের কাছে এতটাই স্পষ্ট হয়ে যায়, যেন মনে হয় সবকিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। তিনি এক একটা শব্দ উচ্চারণ করছেন আর সাথে সাথেই আমাদের সামনে শূন্যে এক একটা দৃশ্যপট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে আমদের সামনে এক একটা দৃশ্যপট হাজির হচ্ছে, যেন-বা আমরা সিনেমা হলে বসে কোনো সিনেমা দেখছি। আমরা আমাদের চোখের সামনেই সবকিছু দেখে চলছি, আমরা জানি না হয়তো আমাদের সাথে আপনারাও দৃশ্যগুলা দেখছেন।
আমরা দেখি, ঘন গাছ-গাছালি, বাঁশঝাড় এবং একটা পুরনো পুকুর। একটু ভালো করে দেখার পর আমরা যারা ছোটোবেলা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি গিয়ে পুকুরে বড়শি বেয়ে মাছ ধরেছি, তাঁরা চিনে ফেলি এটা দেওয়ান হাফিজদের বহু পুরনো পুকুর।
শীতের দুপুর, আকাশে খুব একটা রোদ নেই। একটু একটু রোদ যাইবা আছে তা ঘন গাছগাছালির ডালের কারণে কখনো মাটি ছুঁতে পারে না। এমন শীত শীত আর আলো আধাঁরির দুপুরে আমরা দেখবো হাফিজদের পুকুর পাড়ে টিয়া রঙের ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে। আমাদের কাছে মনে হয় সে কোনো মেয়ে নয়, সে আমাদের কাছে একটা পরি কিংবা একটা ফেরেশতা হিসেবে ধরা দেয়। আবার আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ফেরেশতা কখনো মেয়ে হয়? আমরা নিজেদেরকে এই বলে বুঝ দিই, ফেরেশতা মেয়ে কিংবা ছেলে কোনোটাই হয় না; আমরা এখন যাকে দেখছি সেই হলো ফেরেশতা। আমরা দেখবো আমাদের পরি কিংবা ফেরেশতা পুকুরের পাড়ে একা একা খেলছে, কখনোবা পুকুর পাড়ের সুপারি গাছ থেকে পড়ে যাওয়া পাকা সুপারি কুড়িয়ে নিজের কাছে রাখছে। তাঁকে দেখে আমাদের ভেতরে অনেক ভালো লাগা কাজ করবে। একটু পরেই আমাদের পরি কিংবা ফেরেশতার অদূরে আমরা দেওয়ান হাফিজকে আবিষ্কার করবো। তিনি তাঁর মেয়েকে সঙ্গ দিচ্ছেন। তাঁর সাথে খেলছেন, কখনোবা তাঁকে পুকুর থেকে কচুরিপানার ফুল এনে দিতে দেখবো। কিন্তু কিছু সময় যেতেই আমরা ভিন্ন কিছু দেখি। আমরা দেখি দেওয়ান হাফিজ আচমকাই তাঁর মেয়ে, আমাদের পরি কিংবা ফেরেশতাকে খেলার ছলে পুকুরে ফেলে দিয়েছেন! দৃশ্যটা দেখে আমাদের বুকে কাঁপন ধরে যায়। কাঁপতে কাঁপতে আমরা দেখি, দেওয়ান হাফিজ পুকুর পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁর মেয়ে পুকুরে, বেশ দূরে বরফ শীতল পানিতে মৃত্যুর মুখামুখি হয়েছে! মৃত্যু তো পরের বিষয়, যেই মেয়েকে কোলে নিয়ে শীতের সকালে তিনি রইদ রাজারে রইদ তুলি দে বলে ছড়া বলতেন, যেই মেয়ে কখনো শীতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতো না, সেই মেয়ে এখন বরফ শীতল পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই সাথে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তা দেওয়ান হাফিজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন! সাঁতার না জানা আমদের পরি কিংবা ফেরেশতা বাঁচার জন্য বার বার হাত পা এদিক সেদিক ছুড়ছে, আর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে পুকুরের পানি খেতে খেতে অবিরাম ডেকে চলছে। কিন্তু আমরা দেখি দেওয়ান হাফিজ তখন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ পুকুরে। তিনি কি মেয়ের ডাক শুনছেন না? আমরা জানি না, আমরা তাঁকে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবো। যেন-বা তিনি থিয়েটারে কোনো এক ট্র্যাজেডি নাটকের করুণ কোনো দৃশ্য দেখছেন! পুকুরের পানি খেতে খেতে আর হাত পা এদিক সেদিক ছুড়ে ছুড়ে বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে যখন আমাদের পরি কিংবা ফেরেশতা ক্লান্ত হয়ে যায়, আমরা তখন ধীরে ধীরে মেয়েটার দেহ পুকুরে ডুবে যেতে দেখবো। আমাদের সবার চোখের পানিতে দৃশ্যটি ঝাপসা হয়ে যাবে, আমরা আর কিছু দেখতে পাবো না।
আমাদের এই ঘর প্রচণ্ড নীরব হয়ে যায়, এত নীরব হয় যে আমরা একজন আরেকজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। এই নীরবতায় আমাদের কারো কারো খুব জানতে ইচ্ছে হয়, আমাদের পরি কিংবা ফেরেশতার এমন পরিণতি কেন হলো? আমাদের দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে দেওয়ান হাফিজ নামক একজন বাবার হৃদয়টাকে। কেমন করে একজন বাবা তাঁর মেয়েকে পুকুরে ফেলে দেয়, কীভাবে থিয়েটারের ট্র্যাজেডি নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার মতো দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ের মৃত্যু দেখে? আমাদের কেউ কেউ বারবার দেওয়ান হাফিজের লাশের দিকে তাকায়। হয়তো তাঁরা মৃত দেহের ভেতর সেই বাবা হৃদয়টাকেই খুঁজতে থাকে। কিন্তু তাঁরা কেউ লাশের হৃদয়ে ঢুকতে পারে না, কাফনের কাপড়ের মধ্যেই তাঁদের তীক্ষ্ণদৃষ্টি আঁটকে থাকে। লাশের দিকে, দুধের মতো সাদা কাফনের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমাদের সত্তার পির আবারো কথা বলা শুরু করেন, তাঁর মুখনিঃসৃত বর্ণমালা ভেসে ভেসে আমাদের চোখের সামনে এসে এক একটা দৃশ্যপট তৈরি করে। এবার আমরা একটা পরিচিত সময় দেখি, সময়টা আজ বিকালের। অস্থির এক সময়, যখন আমরা ব্যস্ত আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার বেঁচে থাকা একমাত্র উপাদানের ব্যর্থ প্রয়োগে। আমরা তখন ব্যস্ত ভোটদানে। আমরা তখনো জানতাম না, আদৌ আমরা ভোট দিতে পারবো কি না, বা ভোট দিলেও আমাদের ভোট দেওয়াটা সত্যিকারের ভোট দেওয়া হয়ে উঠবে কি না! সেই অস্থির সময়ে আমরা এক ধীর-স্থির দেওয়ান হাফিজকে দেখি। দেওয়ান হাফিজের পরনে ছাই রঙের ফুল হাতা শার্ট, সেটা তিনি ইন করে পড়েছেন ছাই কালার প্যান্টের সাথে, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তাঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মুখে জর্দা দিয়ে বানানো পান চিবোচ্ছেন। দেওয়ান হাফিজ তাঁর বাড়ির বাংলা ঘরের উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে সিগারেট খেয়ে শেষ করে হাঁটা শুরু করেন। বাংলা-ঘরের উঠান পেরিয়ে, বাড়ির হালট পেরিয়ে, খলা পেরিয়ে তিনি তারাপাশা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া ছোট্ট সুরাই নদীর পাড় দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সে রাস্তা দিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করেন। তাঁর হাঁটার পথ দেখে আপনাদের বুঝতে ভুল হবে না তিনি কোথায় যাচ্ছেন। তিনি হেঁটে চলছেন ৯ নং কুলঞ্জ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র তারাপাশা মাদরাসার দিকে। ভোটকেন্দ্রে দেওয়ান হাফিজ যখন পৌঁছেন তখন কেন্দ্রটা একদম নীরব। প্রায় সবারই ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। হয়তো দেওয়ান হাফিজই সর্বশেষ ভোট-দাতা। ভোটটি দিয়ে দেওয়ান হাফিজ সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন। কিছু কিছু উৎসুক ব্যক্তি দেওয়ান হাফিজের ভোটকেন্দ্রে আসা থেকে শুরু করে যাওয়া সবই ভালো করে লক্ষ করে। অন্য সময় হলে গ্রামের এই মানুষেরা দেওয়ান হাফিজের সাথে কথা বলতো, দেশের রাজনীতির, ভোটের, একটু হলেও খবর নিত কিন্তু কয়েকদিন আগে মাত্র তাঁর মেয়ে মারা গেছে বলে কেউ তাঁকে কোনো প্রশ্ন করে না। তাঁরা নীরবে তাঁর যাওয়া আসা দেখে।
এবার আমরা আর দেওয়ান হাফিজের সাথে তাঁর বাড়ি যাবো না এবার বরং আমরা অল্প একটু সময়ের অতীতে চলে যাবো, যখন দেওয়ান হাফিজ ভোট দিতে কালো কাপড় দিয়ে ডাকা ছোট্ট ঘরটায় ঢুকছেন, সেখানে চলে যাবো। আমরা অতি-উৎসুক হয়ে সেই কালো কাপড়ে ঢাকা ছোট্ট গোপন কক্ষে অদৃশ্যভাবে উঁকি মারবো! উঁকি মারার সাথে সাথে আমরা যা দেখবো তা দেখে প্রচণ্ড রকমের অবাক হয়ে যাবো। তখন আমাদের মনে দেওয়ান হাফিজের পরিচয় উঁকি দিবে। আমাদের প্রথমেই মনে পড়বে দেওয়ান হাফিজ এই গ্রামেরই সন্তান, এই গ্রামে এই মাটিতেই তিনি বড়ো হয়েছেন। তাঁর শরীরে আমাদের এই মাটিরই ঘ্রাণ পাওয়া যায়, ঘাসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, তাঁর ঘামের মধ্যে এই গ্রামের ধানের, এই গ্রামের মাছের গন্ধ পাওয়া যায়, তাঁর রক্তে পাওয়া যায় আমাদের গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান আশরাফ উদ্দিনের রক্ত, যেই রক্তে বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। এইসব পরিচয়ের বাহিরেও আমাদের মনে পড়বে দেওয়ান হাফিজের আরো কিছু পরিচয়, আমাদের তখন মনে পড়বে দেওয়ান হাফিজ সরকারি দলের উঁচু পর্যায়ের একজন নেতা। আজকের এই জায়গায় দেওয়ান হাফিজ একদিনে আসেননি। সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত। রাজনীতির খেলাটা ভালো করে খেলতে পেরেছেন বলে, অনেকের যখন ছাত্রসংগঠন থেকে বের হয়ে মূল দলে ঢুকতে অনেক অনেক দিনের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়, দেওয়ান হাফিজকে এমনটা করতে হয়নি। তিনি ছাত্ররাজনীতি থেকে বের হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মূল দলে জায়গা করে নেন। আর আজকে এত দিন পর, প্রায় বিশ বছর পর তিনি যে আবার তারাপাশায় আসলেন তাও তো তাঁর দলের জন্য। সুনামগঞ্জের নির্বাচনি প্রচারণায় দলকে সাহায্য করার জন্যই তিনি বাড়িতে এসেছেন। তাঁর দল, ক্ষমতাসীন দলের জন্য তিনি চষে বেড়িয়েছেন সুনামগঞ্জের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। তাঁর এই ছুটে চলা বন্ধ হয়েছিল তাঁর মেয়ের মৃত্যুতে। দেওয়ান হাফিজের এইসব পরিচয়ের পর আমরা যখন দেখি তিনি সরকারি দলের প্রার্থীকে নয় বরং তিনি সংগোপনে ভোট দিলেন আমাদের আউয়াল মাস্টারকে, তখন আমদের চমকে উঠতেই হয়!
এবার আমরা দেওয়ান হাফিজের কাছে যাই। আমরা দেখবো তিনি ভোট দিয়ে ঘরে ফিরে কয়েকটা ঔষধের বড়ি খেয়ে তাঁর বাংলা ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর এই ওষুধ খাওয়া দেখে আমাদের কারো কারো মনে উঁকি দিবে দেওয়ান হাফিজের কি কোনো অসুখ বিসুখ ছিলো নাকি? কিন্তু কেউ এর উত্তর জানে না। কেউ কেউ ধরে নেয় দেওয়ান হাফিজের হয়তো শরীর খারাপ করেছে, তাই হয়তো ওষুধের বড়ি খেয়েছেন, তাঁর মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ওপর দিয়ে তো আর কম ধকল যায়নি।
আমরা সবাই দেখবো দেওয়ান হাফিজ নীরবে বসে আছেন আর তাঁর চোখ চলে গেছে অনেক দূরে, বাংলার উঠান পেরিয়ে, বাড়ির খলা পেরিয়ে, বিস্তৃত খেলার মাঠ পেরিয়েও তাঁর চোখ থামেনি। আমরা দেখি তাঁর চোখ তারাপাশা গ্রামের সামনে থাকা নলুয়া হাওর পেরিয়ে বহুদূর চলে গেছে। আমরা দেওয়ান হাফিজের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করবো কিন্তু আমরা সেখানে ব্যর্থ হবো, তাঁর নির্লিপ্ত চোখের ভাষা আমরা কেউই পড়তে পারবো না।
বেলা গড়িয়ে যাবে, পশ্চিম আকাশ লাল করে দিয়ে সূর্য যখন ঘুমোবার আয়োজন করবে তখন আমরা নির্লিপ্ত চোখ নিয়ে বসে থাকা দেওয়ান হাফিজের চোখে চাঞ্চল্য দেখবো! সময়ের সাথে সাথে তাঁর ভেতরে আমরা অস্থিরতা লক্ষ করবো। তিনি একবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াবেন তারপর আবার বসবেন, এভাবে অনেকক্ষণ কাজটা করতে থাকবেন। কখনো-বা তিনি অস্থিরভাবে বাংলা-ঘরের বারান্দায় পায়চারী করতে থাকবেন। এভাবে কিছুটা সময় যাবে, তারপর আমরা বেশ ভয় পেয়ে যাবো! এই শীতে, এই পৌষের গোধূলি-বেলায় যখন শীত আমাদের ওপর জেঁকে বসা শুরু করে তখন আমরা দেখবো আমাদের দেওয়ান হাফিজ অস্বাভাবিকভাবে ঘামছেন! এভাবে ঘামতে ঘামতে একসময় তিনি প্রায় দৌড় দিয়েই বাংলাঘর থেকে বাড়ির পশ্চিম দিকে যাবেন, বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে তিনি দাঁড়াবেন তাঁর বাড়ির পুরনো সেই পুকুর পাড়ে। তারপর আমরা আর কিছুই দেখতে পাবো না।
এরপর দেওয়ান হাফিজকে আমরা একটি লাশ হিসেবেই পাই। তাঁর লাশ আমাদের চোখের সামনে, লাশের চারপাশে আগরবাতির ধোঁয়া উড়ছে। আগরবাতির উথলা করা ঘ্রাণের ভেতরই সত্তার পির আমাদের সবার চোখের সামনে ভিন্ন আরেকটি দৃশ্য হাজির করান। এই দৃশ্যটি দেখে এখানকার সবাই বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তাঁরা দৃশ্যটির সময় নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে, তাঁরা দৃশ্যটির স্থান নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে। এখানকার সবাই বুঝে নেয় এই জায়গাটা তারপাশা নয়, এটি দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা জগন্নাথপুর কিংবা নবীগঞ্জ নয়। এটি সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট কিংবা মৌলভীবাজার নয়। আমাদের সামছু, যার ফুটবল খেলার জন্য এই গ্রাম ওই গ্রাম, এই উপজেলা ওই জেলা থেকে ডাক আসে, সেই সামছুও চিনতে পারে না। আমাদের কাউয়ুম মণ্ডল, যিনি একজন হাজাম, তিনি বাচ্চাদের মুসলমানি করিয়ে দিতে কত এলাকাই যে গেছেন তাঁর কোনো হিসাব নেই, তিনিও এখানে নির্বাক। এমনকি আমাদের আমিন শেখ চাচা, যিনি তাঁর সারাটা জীবন বড়ো বড়ো নৌকায় ধান নিয়ে দেশের এই এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে খেপ দিয়েছেন, সেই আমিন শেখও চিনতে পারেন না! শুধু জায়গা নয়, এই মানুষগুলো সময় নিয়েও বড়ো বিহ্বল হয়ে পড়ে! তাঁরা এই সময়কে চিনে না, তার ওপর এই জায়গাও তাঁদের অপরিচিত।
তারাপাশার মানুষগুলো হয়তো এই জায়গা, এই সময়টা চিনতে পারে না কিন্তু আপনারা কেউ কেউ হয়তো ঠিকই চিনতে পারবেন। আপনারা যখন সত্তার পিরের দাঁড় করানো দৃশ্যের দিকে তাকাবেন তখন হয়তো বুঝে ফেলবেন এটি ঢাকা, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া। আর সময়? সে বড়ো অস্থির সময়, যখন ক্যাম্পাসে মারামারি হয়েছে। হয়তো কেউ মারাও গেছে, মুখামুখি অবস্থানে আছে বড়ো দুই ছাত্র সংগঠন। সেই সময় যখন কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে।
সেই সময়ে, মধ্য রাত পেরিয়ে গেলে, জ্যৈষ্ঠ মাসের উথাল পাতাল ঝড় যখন শুরু হয়েছিল, ঝড়ের সাথে বৃষ্টি তখনো তেমন শুরু হয়নি, শুধু ঝিরঝির বৃষ্টি ছিলো। সেই সময় আমরা আমাদের সামনের দাঁড় করানো দৃশ্যপটে দেখি শিক্ষা ভবনের মোড়, দেখি সুপ্রিম কোর্টের গেইট, দেখি শিক্ষা অধিকার চত্বর। আপনাদের মধ্যে যাদের হৃদয় একটু বেশি সংবেদনশীল, তাঁদের চোখ রাস্তার চারপাশ ভালো করে দেখবে, তাঁরা মানুষ খুঁজবে। তাঁরা খুঁজবে এই রাস্তার পাশে সংসার পাতা মানুষদের, দেখতে চাইবে এই ঝড়ে তাঁরা কেমন করে আছে। কিন্তু তাঁদের চোখ কাউকেই দেখতে পাবে না, এমনকি সুপ্রিমকোর্টের সামনে যে বট গাছ সেটার নিছেও কাউকে পাবে না, পাবে না সুপ্রিমকোর্টের গেইটের নিছে, যেখানে বৃষ্টি পড়ে না, সেখানেও। এই ভ্রাম্যমাণ মানুষগুলো কই আছে সেই হদিস আপনারা যেমন জানেন না, তেমনি আমরাও জানি না। আমরা শুধু দেখি চারপাশ একদম শূন্য, কোনো মানুষ নেই। তবে অচিরেই আমাদের দৃশ্যপটে আমরা একজন মানুষকে দেখতে পাই, তিনি ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে, বৃষ্টি থেকে নিজের মাথাকে বাঁচাতে এক হাত মাথার ওপর রেখে দৌড়ে দোয়েল চত্বরের দিকে যাচ্ছেন। আমরা মানুষটাকে চিনতে পারি, তিনি আমাদের দেওয়ান হাফিজ। তবে লাশ হয়ে যাওয়া পৌঢ় দেওয়ান হাফিজ নয়, একদম তাগড়া জোয়ান দেওয়ান হাফিজ।
মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে, ঘড়ি দেখলে তখন হয়তো রাত একটা কিংবা দুটো; ক্যাম্পাসে এটি তেমন কোনো রাত নয়। এই সময়েই অনেকের কাছে এই ক্যাম্পাস জেগে ওঠে, হলের ছেলেগুলো দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। কারো আড্ডা বসে শহিদ মিনারের পাশে, কেউবা মেডিকেলের পাশে থাকা পরোটার দোকানে বসে পরটা খেতে খেতে আড্ডা দেয়, কেউবা চা খেতে খেতে পলাশীতে গল্প করে, কেউ কেউ আবার টিএসসিতে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে গলা ছেড়ে গান গায়। কিন্তু এখন সময় ভিন্ন। ক্যাম্পাস এখন উত্তপ্ত, কখন কি হয় সেটা বলা যায় না। তাই এখন এই অস্থির সময়ে ক্যাম্পাসে মানুষ নেই বললেই চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল ক’দিন আগেই ভ্যাকান্ট কয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসকে এমন নিঃসঙ্গ দেখে আপনাদের গ্রামের শীতের রাতের কথা মনে পড়বে, এ যেন গ্রামের শীতের মধ্যরাত্রির মতো নিঃসঙ্গ, থমথমে এমনকি এই রাতকে আপনারা কেউ কেউ ভৌতিক বলেও চিহ্নিত করতে পারেন।
এই অস্থির সময়ে, এই অনিশ্চয়তার সময়ে, ছাত্রনেতা দেওয়ান হাফিজ আধো আধো ভয়কে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে আসছিলেন। তাঁর ভয় অন্য কিছু নয়, ভয় তাঁর বিপক্ষ দলের কর্মীদের নিয়ে, এই সময়ে কখন কি হয় তা বলা বড়ো মুশকিল। একটু আগানোর পরই তাঁকে থামতে হলো। ঝিরঝির বৃষ্টি এখন মুষলধারে পড়ছে, বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি এখন আকাশ ভেঙে পড়ছে। সেই সাথে তুমুল ঝড় আর আকাশ কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে, মনে হচ্ছে পৃথিবী ভেঙে পড়বে। সেই সময় দেওয়ান হাফিজকে আশ্রয় নিতে হয়েছে দোয়েল চত্বরের পাশে থাকা যাত্রী ছাউনির নিচে। যাত্রী ছাউনি বললে ভুল হবে, পুলিশ-ছাউনি বলাই শ্রেয়। এখানে সব সময় পুলিশ বসে পাহারা দেয়। কিন্তু অচিরেই আমরা দেখবো দেওয়ান হাফিজ পুলিশ ছাউনির নিচে এসেও নিজেকে বৃষ্টি হাত থেকে বাঁচাতে পারছেন না। বাতাস বৃষ্টির ছাঁট বারবার ছাউনির ভেতরে নিয়ে আসছে। এমন সময় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দেওয়ান হাফিজ ছাউনির স্টিলের বেঞ্চে যখন উঠে দাঁড়াবেন, তখন তিনি লক্ষ করেন এই ঝড়ো রাতে একজন মানুষ এখানে শুয়ে আছে! তাঁর গায়ে বৃষ্টি এসে পড়লেও তাঁর কোনো বিকার নেই! একটু পরেই দেওয়ান হাফিজ বুঝতে পারলেন চৌদ্দ পনেরো বছরের এক মেয়ে এখানে, এই ঝড়ো রাতে, বৃষ্টির ছাঁটের মধ্যে সারা শরীর ওড়না দিয়ে প্যাঁচিয়ে শুয়ে আছে! তিনি দেখলেন মেয়েটা কাঁপছে, প্রচণ্ড কাঁপছে। হয়তো তাঁর অনেক শীত লাগছে। দেওয়ান হাফিজ বার কয়েক ডাক দিলেন, মেয়েটার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি যখন মেয়েটাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সজাগ করতে চাইলেন তখনি তিনি চমকে ওঠেন। মেয়েটার সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! এই জ্বরে, এই ঝড়ো বাতাসের মাঝে মেয়েটা শীতে প্রচণ্ড কাঁপছে, কে জানে হয়তো সে জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে! দেওয়ান হাফিজের ভয় হলো, এই ঝড়ে তাঁর নিজেরই প্রচণ্ড শীত লাগছে আর এই মেয়েটাতো এমনিতেই জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার ওপর ঝড়ের বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে। মেয়েটার সারা শরীরে জড়ানো ওড়নাটা প্রায় ভিজেই গেছে। দেওয়ান হাফিজ বুঝতে পারেন না এখন তিনি কী করবেন। এই ঝড়ের মাঝে তাঁর পক্ষে কী-ইবা করা সম্ভব? তাঁর মাথায় দুশ্চিন্তা উঁকি দেয়, ভাবেন ঠান্ডা লেগে হয়তো মেয়েটা মারেই যাবে! বড়ো অসহায় লাগে দেওয়ান হাফিজকে। আশেপাশে কোনো মানুষও নেই, একদম থমথমে নিস্তব্ধ এই সময়ে প্রকৃতি তাঁর খেলা খেলছে দারুণভাবে! অল্প একটু সময় পরই সৃষ্টিকর্তা সহায় হলেন। উথাল-পাতাল ঝড় কমলো না, বজ্রপাত হতে থাকলো আগের মতোই কিন্তু শুধু বৃষ্টিটা কমে গেলো কিছু সময়ের জন্য। আর তখনি দেওয়ান হাফিজ মেয়েটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কার্জন হলের একটা গেইটের পাশে থাকা ভাঙা স্টিলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক কষ্টে মেয়েটাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কোনো এক ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় মেয়েটাকে শুয়ে রেখে দেওয়ান হাফিজ একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ আমরা এই লাশ রাখা রুমের ভেতরে থাকা মানুষগুলোও স্পষ্ট শুনতে পাবো, তাঁর এই নিঃশ্বাস মনে হলো কত শত বছর ধরে আটকে রাখা নিঃশ্বাস!
এখানে, কার্জনের এই বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট এসে মেয়েটার গায়ে পড়ে না, তাঁর পরিবর্তে মেয়েটার মুখে এসে পড়ে দূরে থাকা বৈদ্যুতিক বাতির আলো। দূর থেকে আসা এই এই আলো মেয়েটার মুখে এসে পৌঁছে অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে। ম্রিয়মাণ আলোয় মনে হয় মেয়েটার মুখে চাঁদের আলো পড়ছে। এই আলোয় মেয়েটার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন দেওয়ান হাফিজ। তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন এসে উঁকি দেয়, তাঁর জানতে ইচ্ছা হয় কে এই মেয়ে, কীভাবেই বা এখানে এভাবে পড়ে রইলো। কিন্তু শেষমেশ এই সব প্রশ্ন দেওয়ান হাফিজের কাছে বড়ো হয়ে উঠে না বরং আমরা দেখতে পাই দেওয়ান হাফিজের চোখে মুখে সেই প্রশান্তিটিই সবচেয়ে বড়ো হয়ে দেখা দেয়। এই প্রশান্তি কোনো মানুষকে বাঁচানোর প্রশান্তি। এই প্রশান্তির সাথে সাথে দেওয়ান হাফিজের তখন মনে পড়ে তারাপাশার লাবিব ভাইয়ের কথা! সেই কত আগে, যখন দেওয়ান হাফিজ একদম ছোটো, যখন তিনি ঠিকমতো সাঁতার কাটতে জানতেন না, তখন একদিন এই প্রশান্তির চিহ্ন তিনি লাবিব ভাইয়ের চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেখেছিলেন। আমরা জানি তারাপাশার মতো হাওর এলাকায় সাঁতার জানাটা কতটুকু দরকারি। সাঁতার না জানলে এই গ্রামে, এই এলাকায় বেঁচে থাকা যায় না। যখন বর্ষায় তলিয়ে যায় সবকিছু, সমুদ্রের মতো হয়ে যায় এই হাওর অঞ্চল, গ্রাম হয়ে যায় এক একটা নিঃসঙ্গ দ্বীপ, সেই সময় দেওয়ান হাফিজ তাঁদের ছোট্ট নৌকাটা নিয়ে হাওরে একা একা বের হয়েছেন। এমন সময় আচমকা ঝড় যখন শুরু হয় তখন তিনি আর তাঁর নৌকা নিজের আয়ত্তে রাখতে পারছিলেন না। একসময় দেখা যায় দেওয়ান হাফিজ নিজেও নৌকায় থাকতে পারছেন না, এবং একসময় তাঁর ছোট্ট নৌকা পানিতে তলিয়ে যায়! শত চেষ্টা করেও হাওড়ের প্রলয়ঙ্করী ঢেউয়ে দেওয়ান হাফিজ নিজেকে পানিতে ভাসিয়ে রাখতে পারেন না, হাওরের পানি খেতে খেতে তিনি যখন মৃত্যুকে একদম স্পর্শই করে ফেলেছেন ঠিক তখনি কোথায় থেকে যেনো লাবিব ভাই তাঁর ডিঙি নৌকা নিয়ে এদিকে আসেন আর তখনি দেওয়ান হাফিজকে মৃত্যু মুখে দেখে তাঁকে বাঁচান লাবিব ভাই। সেই যে মৃত্যু মুখ থেকে বেঁচে দেওয়ান হাফিজ লাবিব ভাইয়ের মুখে একটা প্রশান্তির হাসি দেখেছিলেন, তা আজো তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই প্রশান্তিময় চেহারাটা দেওয়ান হাফিজকে হাতছানি দেয়, তাঁরও ইচ্ছে হয় এই প্রশান্তিটা পেতে। ইচ্ছে হয় কাউকে মৃত্যু-মুহূর্তে বাঁচাতে। ইচ্ছে করতো মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে বেঁচে থাকার আনন্দ কেমন তা অন্য কেউকে বোঝাতে। তাঁর এই ইচ্ছার পেছনে হয়তো কাজ করে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা-বোধ, হয়তোবা অন্য কিছু। আর আজ এই ঝড়ের মধ্যরাতে দেওয়ান হাফিজ কাউকে বাঁচানোর স্বাদ জীবনের প্রথমবারের মতো পেলেন। লাবিব ভাইয়ের সেই প্রশান্তিটাও নিজে অনুভব করতে পারলেন। এই রাতে বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আমরা তাঁর চোখে মুখে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠতে দেখি।
দেওয়ান হাফিজ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বৈদ্যুতিক বাতির আলো কিংবা আমাদের চোখের চাঁদের আলোতে মেয়েটাকে অসম্ভব মায়াবী মনে হয়। বৃষ্টির বেগ বাড়ে, বাড়ে বাজ পড়ার শব্দ, হয়তো মেয়েটার শীত আরো বেশি লাগে। আমরা দেখি মেয়েটা তাঁর দুই হাঁটু ভাঁজ করে তাঁর বুকের কাছে নিয়ে আসে, তারপর সেই দুই হাঁটুকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। দেওয়ান হাফিজের মনে হয় মেয়েটি হয়তো পৃথিবীতে নয়, সে ভ্রূণ হয়ে এই শহরের কোনো মায়ের পেটে শুয়ে আছে। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে কিংবা আমাদের চাঁদের আলোতে আমাদের মনে হয় আমরা কোনো একটা আল্ট্রাসানোগ্রাফির রিপোর্ট দেখছি, যেখানে আমরা দেখি মায়ের পেটে পরিস্ফুটিত ভ্রূণ হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে এই পৃথিবীর এক অনাগত সন্তান। পৃথিবীর সকল রূঢ়তাকে, সকল কদর্যতাকে পাশে রেখে একটা ভ্রূণ সভ্যতার প্রতীক হয়ে শুয়ে আছে মায়ের পেটে। কিন্তু পৃথিবীকে পাশে রেখে নয়, বরং একটা ভ্রূণকে সামনে এসে পৃথিবীর সকল কদর্যতাকে মোকাবিলা করতে হয়। হয়তো সেজন্য, কিংবা অন্য কোনো কারণে আমরা এখন এখানে আগের সেই ভ্রূণও দেখতে পাই না। তাঁর পরিবর্তে আমরা দেখি, কার্জনের বারান্দা, আমরা একটা পরিস্ফুটিত ভ্রূণের পরিবর্তে দেখি এক শ্যামলা কিশোরীর মুখ। এখন আমাদের চোখে ধরা পড়বে কিশোরীর মুখমণ্ডলের অপার্থিব সৌন্দর্য, আমরা বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় কিশোরীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ওঠা নামা করতে থাকা বর্ধিয়মান বুকের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবো। এভাবে সময় চলে যাবে, আমরা খেয়ালও করবো না কখন যে ক্লান্ত শ্রান্ত দেওয়ান হাফিজ ঘুমের ভারে কিশোরীর পাশে এসে শুয়ে পড়েছেন। হয়তো তিনি অনেকক্ষণ ঘুমিয়েও নিয়েছেন।
ঠান্ডা বাতাস যখন আরো বাড়বে, যখন বজ্রপাত কমে আসবে, বিদ্যুৎ চমকানি অনিয়মিত হয়ে যাবে কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি পড়া বাড়বে তখন আমরা দেখবো ঘুমের মধ্যে কিংবা জেগে থেকে দেওয়ান হাফিজ কিশোরীকে জড়িয়ে ধরছেন। আমরা হয়তো তখন ভাববো দেওয়ান হাফিজের খুব শীত লাগছে, হয়তো জ্বরে আক্রান্ত কিশোরীর তপ্ত শরীর জড়িয়ে ধরে দেওয়ান হাফিজ শীত থেকে বাঁচতে চেয়েছেন। কিংবা আমরা তখন দেওয়ান হাফিজের কিশোরীটিকে জড়িয়ে ধরা নিয়ে কোনো কিছুই ভাববো না। আমরা আমাদের সত্তার পরি আমাদের সামনে যে দৃশ্যপট হাজির করেছেন সেটার দিকেই অপলকভাবে তাকিয়ে থাকবো। হয়তো কিশোরীর জ্বরে আক্রান্ত শরীর দেওয়ান হাফিজকে কিছুটা উষ্ণতা দেয়, আমরা দেখবো দেওয়ান হাফিজ কিশোরীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন, আরো কাছে টেনে নিয়েছেন।
জ্বরের ঘোরে মেয়েটা হয়তো তখন কোনো স্বপ্ন দেখে, হয়তো দেখে সে তাঁর বাড়িতে, তাঁদের নিজেদের বাড়িতে মায়ের সাথে শুয়ে আছে, মা হয়তো জ্বরের মধ্যে আদর করে তাঁকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন। তখন আমরা দেখবো মেয়েটি, যে আমাদের চোখে এখন একজন কিশোরী সেও দেওয়ান হাফিজকে জড়িয়ে ধরে। সে হয়তো তাঁর পরম কোন আত্মীয় ভেবে দেওয়ান হাফিজকে জড়িয়ে ধরে। সময় কেটে যায় বহুক্ষণ হয়তো দেওয়ান হাফিজের শীত তখন কেটে যায়। কিন্তু অচিরেই আমরা দেখতে পাই, উষ্ণতা নয় দেওয়ান হাফিজ কিশোরী মেয়েটার দেহে অন্যকিছু খুঁজে চলেছেন। আমরা দেখবো কিশোরীর সর্বাঙ্গে দেওয়ান হাফিজের হাত অদ্ভুত তালে নৃত্য করে চলছে। এক সময় দেওয়ান হাফিজের হাতের নৃত্য থেমে যায়, আমরা তখন দেখবো তিনি বুঁদ হয়ে যান কিশোরীর দেহের ভেতর, বুঁদ হয়ে যান প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসা মানুষের সেই আদিম নেশায়, দেহের নেশায়। তখন আর আমরা দেওয়ান হাফিজ কিংবা জ্বরে আক্রান্ত কিশোরীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবো না। আমরা তখন ভিন্ন দিকে তাকাবো, আমরা সেই বৈদ্যুতিক বাতিটার দিকে তাকাবো, তখন আমাদের কাছে এটি আর একটা চাঁদ কিংবা এর আলো আমাদের কাছে চাঁদের আলো হয়ে ধরা দিবে না। আমাদের কানে তখন শুধু ঝড়ো বাতাসের শব্দই আসবে, তবে বাতাসের শব্দ আমাদের কাছে কান্না হিসেবে ধরা দিবে। আমাদের মনে হবে জীবনের প্রথম বার আমরা এভাবে বাতাসের শব্দ শুনি, অথচ বাতাস, ঝড় কিংবা বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি এই লাশ রাখা ঘরের সবারই ভবিতব্য! তারাপাশা, দিরাই কিংবা সুনামগঞ্জের সবাই ঝড় চেনে, বাতাস চেনে, বৃষ্টি চেনে, আর চেনে ধানের ঘ্রাণ। আজ এই তারাপাশার কিছু মানুষ জীবনের এই প্রথমবার বাতাসকে নতুন করে চিনে। একটু পর আমাদের কানে আর বাতাসের কোনো শব্দ আসবে না তখন বাতাসের শব্দ চাপিয়ে আমাদের কানে একটা প্রকট গোঙানির শব্দ আসবে। এই গোঙানির শব্দ আমাদেরকে এতটাই স্পর্শ করবে আমাদের মনে হবে আমাদের মধ্যের, এই লাশ রাখা ঘরের কেউ হয়তো মারা যাচ্ছে! তবুও আমরা অনুমান করি দেওয়ান হাফিজ হয়তো এমন গোঙানির শব্দকে পাশ কাটিয়ে চোখ বুজে আদিম নেশার ভেতরে তীব্র সুখ খুঁজার চেষ্টা করছেন।
কেন জানি না আমরা সবাই বিকট কোনো চিৎকারের অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনো চিৎকার কিংবা আত্ম-চিৎকারে আমাদের পৌষের শীতের রাত চৈত্র হয়ে যায়নি বরং আমরা লক্ষ করি সময়ের সাথে সাথে গোঙানির শব্দ বাতাসের সাথে বিলীন হয়ে যায়, এবং এক সময় আমাদের কানে অন্য কোনো শব্দ নয়, শুধু বাতাসের শব্দই আসে। আমরা আরো কিছু সময় অপেক্ষা করি, হয়তো একটি কণ্ঠের জন্য আমরা অপেক্ষা করি, হয়তোবা একটা গোঙানির জন্য আমরা অপেক্ষা করি কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আমরা কোনো কিছু শুনি না। এবার আমরা ফিরে তাকাই, সেই বারান্দার দিকে, যেখানে আমাদের দেওয়ান হাফিজ কোনো এক মেয়েকে নিয়ে এসে জীবন বাঁচিয়েছিলেন! কিন্তু বারান্দায় আমরা দেওয়ান হাফিজকে খুঁজে পাই না। বরং আমরা তখন মেয়েটিকে, সেই কিশোরীকে বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখি, আমরা বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় দেখি মেয়েটার চারপাশে রক্ত! মেয়েটি তীব্র লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে, শুধু রক্ত নয়, হয়তো মেয়েটা ঘন সাদা বীর্যেও ভেসে যাচ্ছে! রক্ত কিংবা বীর্যের স্রোতে মেয়েটা ভেসে যাচ্ছে! আমরা দেখি রক্তের আর বীর্যের স্রোত কার্জনের বারান্দা পেরিয়ে একটা নদীর মতো বয়ে চলছে সামনের দিকে, দেখি রক্ত চলে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এই রক্তস্রোতে ডুবিয়ে আরো সামনে, আমরা দেখি গোটা ঢাকা শহর এই রক্ত আর বীর্যের নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে।
একটু সময় যাওয়ার পর আমরা দেখি বৃষ্টির মধ্যে বাহিরের রাস্তা দিয়ে দেওয়ান হাফিজ দৌড়ে চলে যাচ্ছেন। বেশ কিছু সময় পরে মুয়াজ্জিনের আযানে রাতের সমাপ্তি হয়, তবুও আমরা দেখি মেয়েটা, সেই কিশোরী রক্ত কিংবা বীর্যের স্রোতেই পড়ে রয়েছে। তারপর? আমরা একদিন পর এও দেখি পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘কার্জন হল থেকে ধর্ষিতা কিশোরীর লাশ উদ্ধার’।
অনেক সময় চলে যায়, সেই শিরোনাম প্রকাশের অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। আমাদের দেওয়ান হাফিজ সময়ের সাথে বড়ো হয়েছেন, অর্থ এসেছে, ক্ষমতা এসেছে এবং সর্বশেষে তিনি আজ আমাদের সামনে লাশ হয়ে আছেন। মরে গেছেন, কিন্তু আমাদের জানা হয়নি একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে বাঁচানোর প্রশান্তি বা আনন্দ নাকি সেই একই মৃত্যু পথযাত্রী মৃত্যুর পথ থেকে নিয়ে এসে তাঁর ভেতরে মানুষের আদিম নেশার সুরা পান করতে করতে তাঁকে মেরে ফেলার আনন্দটা খুব বেশি? কোন আনন্দ বা কোন প্রশান্তিটা মানুষের কাছে বড়ো সেটা আর আমাদের কারো জানা হলো না।
আমাদেরকে আবার সময়ের বিভ্রান্তি পেয়ে বসে তবে এবার আমরা সময়ের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাই না। আমরা সবাই আমাদের সত্তার পিরের কথা মতো হাজির হই আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগের দৃশ্যে।
এখানে আমরা দেওয়ান হাফিজকে বহু বছর পর, তাঁর বাবা দেওয়ান আশরাফ উদ্দিনের মৃত্যুর পর, তাঁর বাবার চল্লিশার পর, তারাপাশায় প্রথম বারের মতো দেখতে পাবো। আমরা দেখবো দেওয়ান হাফিজ তাঁর বাড়িতে কখনো বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে কখনোবা তাঁর বাড়ির উঠানে বসে তাঁর রাজনৈতিক দলের এখানকার, তৃণমূলের নেতাদের সাথে কথা বলছেন। একদিন, প্রতিদিনের মতো এভাবেই দেওয়ান হাফিজ এলাকার নেতাদের সাথে কথা বলছেন কিন্তু আমরা তখন লক্ষ করবো হঠাৎ দেওয়ান হাফিজ ভীষণ চমকে উঠলেন! এবার আমরা দেখি নেতাদের সাথে কথা বলতে বলতে দেওয়ান হাফিজের চোখ চলে গেছিলো কয়েক উঠান পর মাঈদুলের উঠানে, উঠানে থাকা তারে রোদে শুকোতে দেয়া কাপড় চোপড় নিতে আসা মাঈদুলের ষোড়শীকে দেখেই দেওয়ান হাফিজ এরকম চমকে উঠেছিলেন! কেন তিনি এভাবে চমকে উঠলেন সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আরো পরে আমরা দেখেছি বাড়িতে এই মেয়েটি যখনি তাঁর চোখে পড়ে তখনি তিনি কেমন যেন হয়ে যান, কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে যান। কিছুদিন পর আমরা আবিষ্কার করি দেওয়ান হাফিজের ভেতরে শুধু একটি মানুষের কথাই চলে আসে, সেই যে বহু বছর আগে ‘রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোতে’ ফেলে আসা কিশোরীর কথা, সেই রাতের কথা।
দেওয়ান হাফিজ পাপ করেছেন অনেক, আসলে অনেক সময় অনেক পাপ না চাইলেও করতে হয়, নিজের জন্য করতে হয়, বড়ো হওয়ার জন্য করতে হয়, আর ক্ষমতার রাজনীতি করলে, রাজনীতিতে অনেক বড়ো হতে হলে তো কত পাপ যে করতে হয় তাঁর কি কোনো হিসাব আছে? দেওয়ান হাফিজ তাঁর সবটাই করেছেন। কিন্তু তিনি কখনো সেই পাপ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগেননি। জীবনে দ্বিতীয়বার সেই পাপ নিয়ে কখনো ভাবেননি। কিন্তু আজ তাঁর কী যেন হলো, সারাক্ষণ সেই কিশোরীর কথা মনে হয়, সারাক্ষণ সেই রাতের কথাই মনে হয়, সারাক্ষণ সেই পাপের কথাই মনে হয়।
হাজারো পাপের ভিড়ে সেই কিশোরী, সেই রক্তের স্রোত, সেই বীর্যের স্রোত তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। দেওয়ান হাফিজের এক জীবনের পাপ হঠাৎ যেন মস্ত একটা পাপ-পিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সব পাপ যেন এক হয়ে রাজপথে নেমে যায়। এক সময় রাজপথে এই সব পাপ দেওয়ান হাফিজের নামে উত্তপ্ত স্লোগান দেয়, সেই পাপময় রাতের কথা উচ্চারণ করে। আবার হঠাৎ করেই রাজপথ পাপশূন্য হয়ে কিশোরীতে ভরে যায়। হাজারো কিশোরী তখন রাজপথে, এমনকি দেওয়ান হাফিজ তাঁর নিজের ছ’বছরের মেয়েকে তখন পনেরো বছরের এক কিশোরী হিসেবে রাজপথে, কিশোরীদের ভিড়ে আবিষ্কার করেন। হাজার হাজার কিশোরী তাঁদের ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশে তুলে, মনে হয় সেই হাত প্রথম আসমানে গিয়ে বাড়ি খাবে, হাত আকাশের দিকে তুমুল বেগে তুলতে তুলতে কিশোরীরা একটি পাপের কথাই উচ্চারণ করে, সেই ‘রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোতে’ ফেলে আসা পাপের কথা তাঁরা উচ্চারণ করে।
দেওয়ান হাফিজ নিজের কাছেই বড়ো অসহায় হয়ে পড়েন। যৌবনে, ছাত্রজীবনে রাজপথ থেকে বহু মানুষকে তুলে দিয়েছেন, জীবনে বহু ছাত্র আন্দোলনকে তিনি সেটার জন্মতেই নিশ্চিহ্ন করেছে; কখনো মুখে, কখনোবা হাতে-রডে। কিন্তু আজ এই সব পাপদের মিছিল যেন থামানোই যায় না, সেই সব মিছিল কখনো রূপ নেয় কিশোরীদের মিছিলে, কখনোবা মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যায় তাঁর ছ’বছরের মেয়ে পনেরো বছরের কিশোরী হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর স্লোগান দিচ্ছে ‘রক্তের কিংবা বীর্যের স্রোতে’ ফেলা আসা সেই পাপের কথা বলে। এভাবে তাঁর জীবন যখন চরম রকমের দুর্বিষহ হয়ে উঠলো তখন আমরা দেখতে পাই দেওয়ান হাফিজ তাঁর ছ’বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে, যে আমদের সামনে কখনো একজন পরি হিসেবে কখনোবা একজন ফেরেশতা হিসেবে হাজির হয়েছিলো, সেই মেয়েটাকে তাঁদের পুরনো পুকুরে ফেলে হত্যা করেন। দেওয়ান হাফিজ কীসের জন্য তাঁর ছ’বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে হত্যা করেন? প্রায়শ্চিত্তের জন্য? নাকি কিশোরীদেরকে রাজপথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য? যে জন্যই এই কাজ তিনি করেন না কেন, আমরা দেখি তিনি সেখানে ব্যর্থ হন, যৌবনে ছাত্রদেরকে রাজপথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার যে কাজ তিনি সুনিপুণভাবে করতেন আজ তিনি সেখানে ব্যর্থ হন। আমরা দেখতে পাই পাপদের মিছিল কখনোবা কিশোরীদের মিছিল দেওয়ান হাফিজের পিছন ছাড়ে না। দেওয়ান হাফিজের ছোট্ট মেয়েটা মরে গিয়ে এখন মিছিলে শুধু একটি মুখই দেখা যায়, দেখা যায় কিশোরী হয়ে যাওয়া দেওয়ান হাফিজের নিজের মেয়ের মুখই!
এবার দেওয়ান হাফিজ আর কোনো পথ খুঁজে পান না। রাজপথের সামনে, পেছনে, মাঝে, সবখানে তিনি এখন শুধু মুষ্টিবদ্ধ উদ্যত হাতের তাঁর কিশোরী হয়ে যাওয়া মেয়েকেই দেখেন। এক সময় আমরা দেখি দেওয়ান হাফিজ পাগলের মতো অস্থির হয়ে যান। আর তখনি তিনি সেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেন। মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত! তারপর আমরা দেওয়ান হাফিজকে বিষের বড়ি খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে দেখি। আমরা যদি সেই সময়, যখন দেওয়ান হাফিজ বিষ খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পানির মধ্যে মৃত্যুর মুখামুখি হয়েছিলেন, তখন তাঁর ভেতরে কী কাজ করছিল সেটা দেখতে চাই, তখন দেখবো সেই যে ঝড়ের রাতে, সেই মেয়েটাকে বাঁচানোর পর তিনি প্রথম যে প্রশান্তি পেয়েছিলেন, ঠিক সেই রকমের প্রশান্তিই তাঁর মনের ভেতরে কাজ করে! এই প্রশান্তি, এই আনন্দ ভোগ করতে করতেই একসময় দেওয়ান হাফিজ মারা যান।
আমাদের সত্তার পীরের কথা শেষ হয়ে যায়। আমরা লাশ রাখা ঘরে, লাশের দিকে তাকিয়ে থাকি নীরবে, আমাদের সাথে সত্তার পিরও নীরবে তাকিয়ে থাকেন লাশের দিকে। ধীরে ধীরে লাশ রাখা ঘরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলো, একটু পরেই ফজরের আজান পড়বে। ফজরের নামাজের পরেই দেওয়ান হাফিজের জানাজার নামাজ। একসময় দেওয়ান হাফিজের লাশ খাটিয়ায় তুলে মানুষজন চলতে থাকে মসজিদের দিকে। আমরা বসে থাকি নীরবে। আমাদের মনে একজন ধর্ষক উঁকি দেয়, আমাদের মনে একজন হত্যাকারী উঁকি দেয়, আমাদের মনে একজন স্বীয় মেয়ে হত্যাকারী উঁকি দেয়, আমাদের মনে একজন আত্মহত্যাকারী উঁকি দেয়, আমাদের মনে পাপবোধে পুড়ে যাওয়া ভিন্ন এক মানুষ উঁকি দেয়।
আমরা বসেই থাকি নীরবে, কখনোবা তাকাই আমাদের সত্তার পিরের দিকে। এক সময় দেখি সত্তার পির আমাদের সবাইকে রেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন, দ্রুতই তিনি লাশ নিয়ে মসজিদের দিকে যাওয়া মানুষের স্রোতের সাথে মিশে যান। আমরাও তাঁর সাথে সাথে উঠে দাঁড়াই, আমরাও মন্ত্র-তাড়িতের মতো চলতে থাকি মসজিদের দিকে।