ঘুমে চোখ জড়াতে জড়াতে হঠাৎ ভেঙে যায়, কোনোদিন বা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে করতেও ঘুম আসে না। নিত্যদিনের সংঘাতময় নাগরিক জীবনে নিদ্রা একটু একটু করে চলে যেতে থাকে দূর কোন অচেনা জগতে। আর তখন হয়তো আমি স্মৃতিতাড়িত হই। শৈশব বা কৈশোরের দিনগুলো আসে ফুলের সুবাস নিয়ে। তখন কামিনী বা হাস্নাহেনার বৃষ্টিবাহিত সুবাস মনের কোণে জাগিয়ে তুলতো কোমল অনুভূতি। এক অকৃত্রিমতার সাথে আরেক কৃত্রিমতার যুগলবন্দি ঘটতো।
গন্ধ ছড়ানো ফুল হয়তো লজ্জাবতী। তাই এদের বেশিরভাগই রাতে জেগে ওঠে। সবার চোখের আড়ালে থেকে একটানা গন্ধ বিলোতে থাকে। আর এ গন্ধের সম্মোহনে মানবচিত্ত হয় পুলকিত। বিবমিষাময় জগতে এটি কম কী?
ফুলের গন্ধ বাড়ে, সাথে রাত বাড়ে আর ফেসবুকে আলোড়ন ওঠে, হাতের মুঠোয় ঘুরতে থাকে বিশ্বটা। এ মোহময় জগত বাকি সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। রাতের নির্জনতা বা ফুলের গন্ধ মনে আর কোন অনুভূতি জাগায় না। মোহময়তায় ডুবে থাকতে থাকতে নির্ঘুম রাতের ব্যাপ্তি বাড়ে। বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদেরকে ঘুম পাড়ানি গানের বদলে দেয় মাদক, পর্ণ মুভি- আর আমরা রাত জাগি। ফলে আমরা সূর্যোদয় দেখি না , আমরা সূর্যাস্ত দেখি না। নিয়ন আলোর রহস্যময়তা আমাদেরকে ধোঁকা দেয়। আর এ আলোর ফাঁকে ফাঁকে পড়ে থাকে গৃহহীন মানুষেরা।
একাকি কে? তুমি? আমি? কে-ই বা একাকি থাকতে পারে! এ ওর সাথে ও এর সাথে নানা ধরণের সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে যাই একাকিত্বের সুর লীন হয়ে থাকা সত্ত্বেও । নানামাত্রিক সম্পর্কের মাঝখানে দিনে দিনে বেড়ে ওঠে রাগ , অভিমান- ন্যূনতম মতদ্বৈততায়। আরে ও প্রান্তে কে? সে আমার প্রিয়জন, একান্ত আপন। দেশে মুঠোফোনের প্রসারের কালে ফ্রি মিনিটের সুযোগ নিয়ে আমি রাত জাগতাম। তুমিও জেগে থাকতে আমার সাথে। আমাদের কথা হতো, আমাদের প্রেম হতো, রাতজাগা ফুলের সাথে জেগে জেগে ভোর হতো। সেসব দিন বিগত হলেও এখনো মাঝে মাঝে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে দিনযাপনের অমোছনীয় চিত্রমালা।
তুমি কী এখন রাত জাগ? কোন এক রহস্যময়তায় ডুবে থাক রাতব্যাপী? তুমি এখন গন্ধ নাও টবে রাখা সুবাস ছড়ানো ফুলগুলো থেকে? টববন্দি ফুল । আহা, টববন্দি ফুল , বড় একা লাগে তাদেরকে। তুমিও কি কোন একাকিত্ব অনুভব করো ? নাকি যৌথতার অনুভবে মিশে যাও তাদের সাথে? স্থান এবং কাল এবং সম্পর্কের দূরত্বের কারণে অজনাইে থেকে যাবে আমার কাছে তোমার বর্তমান জীবনপ্রণালী।
আমরা সবুজায়নের কথা শুনতে শুনতে বড় হই কিন্তু গাছ কেটে ফেলি নির্দ্বিধায়। আমরা বনসাই করি শৈল্পিক মনোবৃত্তি নিয়ে। এরই ফাঁকে হাওয়ায় ওড়ে চলে যৌথতার চিহ্নগুলো। তুমি আবর্তিত হতে থাকো তোমার জগতে আর আমি চলি আমার বৃত্তে। তবু আমাদের কাছে উৎসব আসে। ফুলেরা ছড়িয়ে থাকে সারা উৎসবে। আমরা ফুল চালাচালি করি ভালোলাগার অনুভবে। কিন্তু বৃন্তচ্যূত একাকি ফুলের কষ্ট আমরা অনুভব করতে পারি না।
রাতজাগার ক্লান্তি আসেনা । কেননা আমরা তখন মেতে থাকি মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমুতে। প্রবাসী স্বামী রাতে কল দেয় বউয়ের সাথে একাকি কথা বলতে। তরুণ প্রেমিক প্রেমিকা রাতে মেলে ধরে একে অপরের কাছে। যৌনতাও কী মিশে তাকে এর সাথে? হয়তোবা। এ ধরনের আলাপনের জন্য রাতই তো উত্তম। এ সময় কাঙ্খিত জনকে পাওয়া যায় একান্তে। রাতজাগা পাখিদের সাথে তাই তাদের মিতালী গড়ে ওঠে। ফোর জি’র স্পিড নিয়ে সমালোচনা করতে করতে আমরা ভুলে যাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা। বিশ্বায়ন বলে- মুক্ত হও, মুক্ত হও, দ্বার খুলে দাও, বাজার অবাধ করে দাও। হ্যাঁ তুমি স্বপ্ন দেখ, না পারলে আমরাই স্বপ্ন দেখাব তোমাকে, তুমি নতুনের আহ্বানে সাড়া দিবে বিনা প্রশ্নে, তাই তোমাকেই আমাদের দরকার। তাই তোমার জন্য আমরা নানা ধরনের প্যাকেজ অফার করি, রাত জাগার সুযোগ করে দেই। কিন্তু রাতের আঁধারে মুদ্রার ভৌগোলিক সীমা অতিক্রমণ কেউ দেখতে পায় না।
দিনযাপনের গ্লানি চোখের কোণে জমা হলে রাতের ঘুম উবে যায়। পারিবারিক জমা খরচের হিসাব বা সম্পর্কের টানাপোড়েন, চাকরি বা ব্যবসা সংক্রান্ত নানান প্রতিকূলতা মাথার ভেতর ভনভন করে। এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা রাতকে প্রলম্বিত করে। মস্তিষ্কের কোণে কোণে যেন পোকা কামড় দিতে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে অযাচিত ঘটনাগুলোর পরম্পরা। মনের ভেতরে চলতে থাকে এমনতরো নানান প্রশ্ন কিংবা শঙ্কা যার হয়তো কোনো ভিত্তি আছে বা আদৌ যা কোন যুক্তির ধার ধারে না। ঘুমের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা তাই শেষ হয় না। একদিন কাটে, দ’ুদিন কাটে, এভাবে দিন এগুতে থাকলে বাধ্য হয়ে নিতে হয় ক্লোনাজিপাম ট্যাবলেট। ঘুমের রাজ্য তখন নিকটে আসে; ফুলের গন্ধ নিতে নিতে বা কোন ফুলেল গন্ধ ছাড়াই। ঘুম নেমে এলেই প্রশান্তি আসে। ট্যাবলেটকে মনে হয় অমৃত।
নির্ঘুম রাতের সহচরীদের সবাই কি ঘুমিয়ে পড়ে যখন তোমার দু’চোখ ভরে ঘুম নেমে আসে? নাকি কেউ কেউ ‘কাব্য লেখার ভাঁজ’ খুলে বসে? এদের জাগরণ হয় শিল্প সৃষ্টির উন্মাদনায়। মনের ভেতরের উথাল পাথাল ঢেউ ঘুমকে দূরে ঠেলে দেয়। শব্দের সাথে শব্দ মেলাতে মেলাতে, বাক্যের সাথে বাক্য মেলাতে মেলাতে এরা ঢুকে পড়ে নিদ্রাহীনতার জগতে। ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ মনের কথা বলার জন্য এরা এদিক ওদিক হাতড়াতে থাকে ক্লান্তিহীন। যদি মনের মতো একটি শব্দ এসে যায়, যদি মনের মতো একটি বাক্য এসে যায়, কি যে প্রশান্তি আসে তখন। এতসময়ের পথচলা আদৌ কষ্টের কোন প্রলেপ বসাতে পারে না। শব্দের ব্যঞ্জণার সাথে ফুলের সুবাস মিলে একাকার হয়ে যায়। এ এক মাদকতা জড়ানো অনুভব, এক ঘোরলাগা জগতে পরিভ্রমণ। বৈষয়িক হিসাব নিকাশের সাথে যার কোন সম্পর্ক নাই। সৃজনের এই যাত্রাপথে একাকি থাকা লাগে- নিজে ছাড়া অন্য যে কেউ এখানে অনাহূত।