একজন শিল্পীর জন্যে বারাদ্দ থাকে নিজস্ব অন্তর্গত শিল্পসরণি। যেখানে অব্যাহত থাকে অন্তহীন দীর্ঘ মানসভ্রমণ। অন্তর্গত এই সরণি মূলত স্বপ্ন-কল্পনা ও আবেগের সমন্বয়ে তৈরি। তবে মানুষ মাত্রই কম বেশি স্বপ্ন-কল্পনা কিংবা আবেগের কারবারি। এক্ষেত্রে একজন সৃজনশীল শিল্পী সাধারণের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। স্বপ্ন-কল্পনা-আবেগ তাদের জন্য বিস্ময়কর ভুবন। মনোরাজ্যের নানা স্তরে ভাবের যে অসীম লীলা। এসব নিয়েই তো একজন সৃজনশীল ব্যক্তির কাজ। দর্শন শাস্ত্রে স্বপ্ন-কল্পনা-আবেগ সম্পর্কে আলাদা অধ্যায় আছে। মানবমনের দুর্জ্ঞেয় অঞ্চলের খোঁজ পেতে বিভিন্ন সময়ে দার্শনিকগণ এসবের আলোচনা করেছেন। যিনি কবি, যিনি শিল্পী, যিনি শিল্পের সৃজনক্রিয়ার সাথে জড়িত। তিনি শৈশবকৈশোরেই অতিমাত্রায় স্বপ্ন-কল্পনা কিংবা আবেগের আহ্বান পেয়ে থাকেন। বলতে চাইছি, একজন সৃজনমুখর শিল্পী হঠাৎ করেই শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন না। শৈশবকৈশোরেই তৈরি হয় শিল্পের বীজতলা।
মনে পড়ে, আমার বাড়ির কোল ঘেঁষে মায়াময় এক নদীর নাম ডাকাতিয়া। ষড়ঋতুর বহু বর্ণিল রূপ আমি এই নদীর কিনারে বসে দেখেছি। নদীর দু’কূলজুড়ে ঘরবাড়ি। মানুষের বিচিত্র দিনযাপন। কোথাও পাড় ভাঙার হাহাকার। ছোটো ছোটো জেলে নৌকাগুলো ভেসে আছে নিঃশব্দে। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলে মনেহয় অন্য এক পৃথিবী। রাতের বেলায় গাঢ়রূপ অন্ধকারে নদী যেন তারাভরা আকাশ। জ্বেলের নৌকোয় কেরোসিনের কুপিগুলো মিটমিট করে জ্বলতে থাকে। হঠাৎ মাঝরাতে গান গেয়ে বাড়ি ফেরে কোনো হাঁটুরিয়া। কিংবা উদাসী কোনো সওদাগর নৌকায় বসে বাঁশির সুরে প্রকাশ করে মনের গোপন কথা। এই যে নদী তীরবর্তী ব্যতিক্রম জীবন। এটা আমার শৈশবকৈশোরের মানসগঠনে ছিলো বেশ প্রভাববিস্তারি।
লাকসাম থেকে চাঁদপুরগামী রেললাইন এবং নিকটবর্তী নদী ডাকাতিয়া। এখানে আমার বেড়ে ওঠা। এই দুইয়ের কাছে স্বীকার করি সীমাহীন শিল্পঋণ। ছোটোবেলায় বিনাটিকেটে রেলভ্রমণ ছিলো এক ধরনের এডভেঞ্চার। ধরা খাওয়ার ভয়ে এক স্টেশন পর পর বগি পরিবর্তন। তারপর বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে লাকসাম কিংবা হাজীগঞ্জ গিয়ে সিনেমা দেখা। তারপর রেল জংশন থেকে গল্প-উপন্যাসের বই কেনা। তারপর রাস্তার পাশে সাপুড়িয়ার সাপখেলা। তারপর ওষুধ হিসেবে গাছের শেকড় বিক্রি। আহা, হারিয়ে গেছে সেই ঘর্মাক্ত দিন। পাগল পাগল দিনগুলো।
ডাকাতিয়া নদীর ঘাটে বেদে সম্প্রদায়ের অসংখ্য নৌবহর। নদীর তীরে বসে দেখতাম নিপুণ হাতে বেদে তরুণীর ধোঁয়া ওড়া রান্নার দৃশ্য। ছোট্ট পাতিলে টগবগ করছে ফুটন্ত ভাত। এসব দেখে দেখে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বাড়ি ফিরতাম। মায়ের বকুনি খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতাম। কিন্তু আমার চোখে ভাসে বেদে সম্প্রদায়ের নৌবহর। কানে বাজে কুঝিকঝিক ট্রেনের হুইসল। এই ছিলো আমার শৈশবের সীমাহীন শিল্প অনুভবের যৎসামান্য কথা।
শিল্পের নানা শাখা আমাকে টানে। কাজ করতে ভালোবাসি। তবে এসবের মাঝে কবিতাই প্রথম প্রেম, প্রথম আহ্লাদ। কবিতা আমাকে দিয়েছে কারুকার্যখচিত কল্পাকাশ। যেখানে নিঃশব্দে চলে অলৌকিক আনন্দবিহার। ফলে শিল্পের সরণিতে কবিতাই আমার অন্তিম আরাধ্য। কিন্তু কখনোবা পাঠাভিজ্ঞতার আলোকে লিখি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক গদ্য। বিভিন্ন সময়ে পড়তে পড়তে মাথার মধ্যে যে চিন্তাবিন্দু জমা হয়েছে, গদ্যগুলোতে তার প্রকাশ হয়তো দেখা যাবে।
সমকালীন তরুণদের মধ্যে গদ্য কিংবা শিল্পসমালোচনামূলক সাহিত্য চর্চার প্রতি আগ্রহ কম দেখা যায়। এর পেছনে দুটি কারণ ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, পরিশ্রমের কাজ বলে অনেকে এড়িয়ে যান। দ্বিতীয়ত, শিল্পসমালোচনার জন্য যে গভীর অভিনিবেশ এবং পাঠপরিধি প্রয়োজন। পৃথিবীর খ্যাতিমান কবি-শিল্পীরা মৌলিক সৃষ্টির পাশাপাশি শিল্পসমালোচনামূলক গদ্য লিখেছেন। সমকালীন নানা ইস্যু নিয়ে মতামত দিয়েছেন। পরস্পরের বইপত্র নিয়ে সমালোচনা লিখেছেন। গ্রিক-রোমান, ইংরেজি, ফরাসি, রুশসহ বিভিন্ন ভাষার কালজয়ী কবিশিল্পীদের রচনাসম্ভার খুঁজে দেখলে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ উত্তরকালের খ্যাতিমান কবিসাহিত্যিকগণ প্রবন্ধ কিংবা সমালোচনাধর্মী লেখা লিখেছেন। বর্তমানে সমালোচনা সাহিত্যের ধারাটি কিছুটা নিষ্প্রভ। এই ক্ষেত্রে আমাদের আরও কাজ করা দরকার।
শিল্পের সরণি এখন বিভাজনে জর্জরিত। আদিকাল থেকেই মানুষ জোটবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। ফলে গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে সাহিত্যচর্চা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এখন পত্রিকা এবং সংগঠন কেন্দ্রিক যে গোষ্ঠীবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বোধকরি এটাও এক ধরনের অচলায়তন। নবীন যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত হতে চাইছেন। অচলায়তনের খপ্পরে পড়ে যদি তারা অন্ধ হয়ে যান। তবে স্বাধীন শিল্পচর্চার পথে কিছুটা অন্তরায় তৈরি হয় বৈকি। গোষ্ঠীবদ্ধ কবি-সাহিত্যকরা পারস্পরিক কুৎসা রটানোর মধ্যে থেকে বেশ আমোদিত হন।
গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে আমাদের এখানে ভালো সমালোচনা সাহিত্যধারা গড়ে উঠেনি। কারণ গোষ্ঠীবদ্ধ লেখকেরা কেবল নিজেদের সাহিত্য নিয়েই আলোচনা করে তৃপ্ত হয়। অধিকাংশ সময় সেই আলোচনা শৈল্পিক মানদণ্ডের বিবেচনা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত তোষণে রূপ নেয়। ফলে নৈর্ব্যক্তিক সাহিত্য সমালোচনার ধারা দিনকে দিন আরো অনুর্বর হয়ে উঠেছে। তরুণ কবিযশপ্রার্থীরা দ্রুত এইসব গোষ্ঠীবদ্ধ বৃত্তের ভেতর স্রোতের তোড়ে আটকা পড়ে।
কবি বা লেখক হওয়ার জন্য মোহ থাকা সমীচীন নয়। তবে সুদুর স্বপ্ন থাকা ভালো। মোহ না বলে আমি বরং এটাকে ‘শিল্পজেদ’ বলি। অর্থাৎ কবি বা লেখক হওয়ার জন্য প্রয়োজন শিল্পজেদ। যিনি স্বীয় অন্তঃকরণে শিল্পসৃজনের তাগাদা অনুভব করেন। তিনিই কেবল মহৎশিল্প সৃষ্টি করেন। জাগতিক ভোগবিলাস, খ্যাতি কিংবা আর্থিক প্রতিপত্তি লাভ করা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে। তখন শিল্পের দায়বদ্ধতার জায়গা নষ্ট হয় বৈকি। তবে সবার যাপিত জীবন একরকম হয় না। সুখে-দুঃখের সংজ্ঞাও ব্যক্তিভেদে আলাদা। শিল্পী কিংবা কবি-মনে চিরন্তন দুঃখবোধের একটা অদৃশ্য নহর প্রবাহিত হয়। যার ফলে শত আনন্দময়তার ভেতরেও একজন শিল্পী সেই নহরে নিঃসঙ্গতার নৌকায় ভেসে থাকেন। এই প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের লেখা কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে গেলো। ‘খুব বেশি ভালো থাকতে নেই’ কবিতায় তিনি বলেন :
সংগীত সাধক, কবি; চিত্রকর অথবা ভাস্কর, কাউকেই
খুব বেশি ভালো থাকতে নেই।
খুব বেশি ভালো থাকা মানে
মোহের নাছোড় লতাগুল্মসমেত স্নোতের টানে
সেখানেই অনিবার্য খড় ভেসে-যাওয়া,
যেখানে কস্মিনকালে বয় না শিল্পের জলহাওয়া।
শিল্পের হিত ও অহিত কিংবা শ্লীল ও অশ্লীল বিতর্ক দেখা যায়। শিল্পসাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারটি নতুন নয়। অশ্লীলতার অভিযোগে এ যাবত নামকরা অনেক শিল্পকর্মই বিতর্কিত হয়েছে। মূলত এই বিভেদ ব্যক্তির পাঠপ্রস্তুতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে শিল্প একজনের কাছে অশ্লীল কিংবা প্রাপ্তমনস্কদের সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত, ঠিক অন্য কারো কাছে সেটা অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার দৃষ্টান্তও কম নেই। ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটি ১৯২৯ সালে ব্রিটেনের আদালতের নির্দেশে ত্রিশ বছরের অধিককাল নিষিদ্ধ ছিল। অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বইয়ের কপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ উত্তরকালে এই গ্রন্থ বেশ সমাদৃত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে কালিদাসের ‘মেঘদূত’, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, তারাশঙ্করের ‘কবি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘জিন্দাবাহারের গলি’-সহ অসংখ্য গ্রন্থের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে—যেখানে যৌনতার খোলামেলা বর্ণনা পাওয়া যায়।
শিল্প তো মানব জীবনের উত্তম রূপায়ণ। যদি তা-ই হয়, তবে মানব-মানবীর যৌনজীবন শিল্প-সাহিত্যে উপেক্ষিত হতে পারে কি? নিঃসন্দেহে পারে না। শুদ্ধতাবাদী শিল্প-তাত্ত্বিকেরা হয়তো বলবেন, যৌনতার প্রকাশ শিল্পে শৈল্পিক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সাহিত্যে যাঁরা বাস্তব জীবনের রূঢ় সত্যকে উপস্থাপনে উৎসাহী, যাঁরা মানব জীবনের অনালোকিত অধ্যায়কে কোনোরকম ভণিতা ছাড়া শিল্পরূপ দিতে চান, তাঁদের সঙ্গে শুদ্ধতাবাদী শিল্পপ্রেমিদের মতবিরোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমার কাছে মনেহয় শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারটি একান্তই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
ব্যক্তিভেদে বোধের জায়গা থেকে শিল্প স্বতন্ত্র অর্থ দেয়। আর এভাবেই গড়ে ওঠে লেখকের নিজস্ব শিল্পসরণি। যে সরণি কেবল তাঁর একলা হাঁটার। নির্ভার থাকার জন্য কিংবা ভাবের ভারবাহী হয়ে হাঁটার জন্য এই শিল্প সরণি সকল কবি-শিল্পীর জন্যই জরুরি বৈকি।